মতামত

সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণ কী ধসাল, ভবন নাকি উন্নয়নের অহংকার?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ দেরি হচ্ছে আলোর স্বল্পতা এবং ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত কি না, সে ব্যাপারে সঠিক তথ্যপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষার কারণে।
ছবি : প্রথম আলো

গুলিস্তানের পাশে সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের পরবর্তী ঘটনা আমার সামনে নিয়ে এল ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় ওএমএসের ট্রাক থেকে চাল কেনা নিয়ে মানুষের যুদ্ধের কথা। কেন তা মনে হলো, সে আলোচনায় আসার আগে আমাদের জনপরিসরে কয়েক দিন ধরে আলোচিত বিস্ফোরণ নিয়ে কিছু আলাপ সেরে নেওয়া যাক।

ঘটনাটি ঘটেছিল বিকেলে। রাতে এর উদ্ধার অভিযান স্থগিত হয়ে যায়।  অপেক্ষা করা হয় পরের দিন দিনের বেলা আবার উদ্ধার অভিযান শুরু করার। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ দেরি হচ্ছে আলোর স্বল্পতা এবং ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত কি না, সে ব্যাপারে সঠিক তথ্যপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষার কারণে।

বিস্ফোরণের কারণে ভবনটির বেশ কয়েকটি কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি ভবনের যখন মূল কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন ভবনটির ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কোনো বিশেষজ্ঞকে সে ভবনের উদ্ধারকাজের জন্য নিরাপদ কি না, সেটি নিশ্চিত করতে হয়। একটি চরম দুর্যোগপূর্ণ জরুরি সময়ে বিশেষজ্ঞকে জরুরি ভিত্তিতে নিয়ে আসতে না পারা কিংবা পর্যাপ্ত আলো না থাকায় অভিযান পরিচালনা না করতে পারার কথা শুনলে বহির্বিশ্বের অনেকেই অবাক হলেও অবাক হবেন না এ দেশে বাস করা কিংবা নিয়মিত খোঁজখবর রাখা মানুষেরা।

ঘটনাটি যেদিন ঘটে সেদিন এ তথ্য জানা যাচ্ছিল, বেজমেন্টে মানুষ আটকে আছে। ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন নেই, সাধারণ সচেতন মানুষ জানেন, এ ধরনের দুর্ঘটনায় যখন মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হন, তখন মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ থাকে রক্তক্ষরণ। বহু সময় এমন কোনো মারাত্মক আঘাত না-পাওয়া মানুষও শুধু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যান। তাঁদের জীবন আর মৃত্যুর মধ্যখানে শুধু এটুকু পার্থক্য থাকে—তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হবে এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় পরিমাণে রক্ত দেওয়া যাবে।

সরকারের উন্নয়নকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা ভুখা মানুষের এ লাইন বন্ধ করার জন্য সরকার টিসিবির ট্রাকের মতোই ওএমএসের জন্য কার্ডের ব্যবস্থা করছে। এতে অল্প কিছু লোককে কার্ড দেওয়া, এবং কার্ড ছাড়া পণ্য পাওয়া যাবে না—   এই ঘোষণার কারণে ট্রাকের পেছনে অসংখ্য মানুষের লাইন আর তৈরি হবে না। সরকার-প্রতিশ্রুত স্মার্ট বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের একটি স্মার্টপদ্ধতি। কিন্তু না, কার্ড ছাড়া চাল দেওয়া না হলে ওএমএসের ট্রাকের পেছনের লাইন এবং একে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা গেলেও আমরা কি মেনে নেব উন্নয়নকে?

মানুষ আটকে আছে, এমন একটা পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ দলকে ভবন নিরাপদ কি না, সেটা নিশ্চিত করার জন্য কোনো জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এ রকম বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের অতি দ্রুত দুর্গত স্থানে এনে মতামত নেওয়ার ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল। কথা ছিল, অন্ধকারকে দিনের আলোর মতো বানিয়ে ফেলার সক্ষমতা থাকার। রাতকে দিন বানিয়ে আমরা ক্ষুদ্র একটি বল স্পষ্ট দেখা যাওয়ার মতো দিনের আলো বানিয়ে ক্রিকেট তো খেলি বহুকাল আগে থেকে।

পরের দিনের অপেক্ষায় ছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন ছিল পরের দিনের পরিস্থিতি? দুর্ঘটনার পরদিন প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘সিদ্দিকবাজারের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, নেই যন্ত্র, উদ্ধার অভিযান ব্যাহত’ একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে দুর্ঘটনার পরের দিনের পরিস্থিতি। সে প্রতিবেদনের কিছু অংশ এ রকম—

 ‘ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে উদ্ধার অভিযান চালাতে বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ দিতে হয় উদ্ধারকর্মীদের। গতকাল বুধবার বেলা তিনটা পর্যন্ত তাঁরা কয়েকটি সংস্থার সহযোগিতা চেয়েও পাননি। এ ছাড়া ভবনটির বেজমেন্টে উদ্ধার অভিযান চালাতে প্রয়োজন শোরিং (ঠেক দেওয়ার) নামের বিশেষ যন্ত্রের, যা ফায়ার সার্ভিসের কাছে নেই। তাঁরা রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কাছে এ যন্ত্রের জন্য সহযোগিতা চেয়েও পাননি বলে অভিযোগ করেন’। হ্যাঁ, এসব ঘটছে এমন একটি দেশে, যে দেশের ক্ষমতাসীনেরা দাবি করেন, বাংলাদেশ নাকি সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে।

বহু সময় এমন কোনো মারাত্মক আঘাত না-পাওয়া মানুষও শুধু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যান। তাঁদের জীবন আর মৃত্যুর মধ্যখানে শুধু এটুকু পার্থক্য থাকে—তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হবে এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় পরিমাণে রক্ত দেওয়া যাবে।

খেয়াল করা যাক আরেকটি দিকে। এ দুর্ঘটনায় আহত মানুষের সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০০-এর মতো। তাঁদের মধ্যে একটা অংশ চিকিৎসা নিতে গেছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। বাকিরা, অর্থাৎ ১০০-এর মতো কিংবা কিছু বেশিসংখ্যক মানুষ গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। এসব রোগীর চাপে দেশের সবচেয়ে বড় জেনারেল হাসপাতালটির চিকিৎসাব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়ল, তা অনেককেই অবাক করে দেওয়ার মতো। এ মেডিকেল কলেজের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি, স্বাভাবিক অবস্থাতেই রোগীর চাপে কী রকম হিমশিম খেতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা দেওয়া মানুষদের (ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট)। জিডিপির অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম কম ব্যয় (এক শতাংশের নিচে) করা বাংলাদেশের তথাকথিত উন্নয়নের প্রভাব পড়ে না শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তার মতো স্বাস্থ্য খাতেও।

মাসখানেক আগে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আবার। এ আলোচনা নতুন নয়। আলোচনা চলছে গত ১০-১২ বছর থেকেই। তিব্বত প্লেট, মিয়ানমার সাব-প্লেট ও ইন্ডিয়া প্লেটের সংযোগস্থলে একটি ভয়ংকর ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। আছে ডাউকি ফল্টে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিও। এ সবগুলোর প্রলয়ংকরী প্রভাব পড়বে দেশের অনেক জায়গায়, যার মধ্যে আছে ঢাকাও। তাই তুরস্কের মতো একই মাত্রার না হোক, এর চেয়ে অনেক কম মাত্রার ভূমিকম্পও যদি হয়, তাতে ঢাকা শহরের হাজারখানেক বাড়ি ভেঙে পড়বে। আর এতে এখানকার অবস্থা কতটা বিভীষিকাময় হবে, সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছি আমরা।

ঘটনাচক্রে সিদ্দিকবাজার অবস্থিত এমন একটি জায়গায়, যার খুব কাছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রধান কার্যালয়। ঘটনাটি যেহেতু ঢাকা শহরে ঘটেছে, দুর্যোগ মোকাবিলা এবং চিকিৎসার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা আছে এ শহরেই। সে শহরেই একটিমাত্র ভবন ধসে যাওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতি আমাদের সামনে নিয়ে আসে এক ভয়ংকর বার্তা। এ পরিস্থিতি যদি হতো অন্য কোথাও, তাহলে কী হতো? শিউরে উঠছি না ভেবে?

একটির পর একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার যৌক্তিকতা দেশে-বিদেশে তৈরি করার জন্য সরকার ‘উন্নয়ন’কে আশ্রয় করে। প্রয়োজনীয় ন্যায্য ব্যয়ের কয়েক গুণ খরচের মাধ্যমে কিছু ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং কিছু গোঁজামিলের হিসাব দিয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়কে উন্নয়ন বলে চালিয়ে দেওয়া মানুষ গ্রহণ করে না বহুদিন আগে থেকেই। কারণ, একটার পর একটা পরিস্থিতি আমাদের সামনে এসে তথাকথিত উন্নয়নকে তুমুল তাচ্ছিল্য করে। ওএমএসের লাইনের কথা মাথায় এল এ প্রেক্ষাপটেই।

গত বছর টিসিবির পণ্যের ট্রাকের পেছনের লাইন আর এ বছর ওএমএসের চালের ট্রাকের পেছনের লাইনের মর্মান্তিক সব গল্পে ভরে গেছে গণমাধ্যম। গত বছরের টিসিবির লাইনের মতো এ বছর ওএমএসের লাইন নিয়ে প্রথম আলো অনেকগুলো প্রতিবেদন করে দেখিয়েছে, শুধু কম দামে চাল কিনে কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য সমর্থ মানুষসহ প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ মানুষকে কী ভয়ংকর লড়াইটাই না করতে হচ্ছে। এবারের লড়াইটা পেঁয়াজ, চিনি, সয়াবিন তেল, ছোলার মতো ‘বিলাসী পণ্য’ নয়। এবারের লড়াই একেবারে শেষ অত্যাবশ্যকীয় বস্তু ভাতের লড়াই। এ লড়াইয়ে সবাই জেতে না, অনেকেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও পায় না কম দামের কিছু চাল।

সরকারের উন্নয়নকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা ভুখা মানুষের এ লাইন বন্ধ করার জন্য সরকার টিসিবির ট্রাকের মতোই ওএমএসের জন্য কার্ডের ব্যবস্থা করছে। এতে অল্প কিছু লোককে কার্ড দেওয়া, এবং কার্ড ছাড়া পণ্য পাওয়া যাবে না—   এই ঘোষণার কারণে ট্রাকের পেছনে অসংখ্য মানুষের লাইন আর তৈরি হবে না। সরকার-প্রতিশ্রুত স্মার্ট বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের একটি স্মার্টপদ্ধতি। কিন্তু না, কার্ড ছাড়া চাল দেওয়া না হলে ওএমএসের ট্রাকের পেছনের লাইন এবং একে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা গেলেও আমরা কি মেনে নেব উন্নয়নকে?

একইভাবে চারপাশে উন্নয়নের ভীষণ ডামাডোলের মধ্যে একটি ভবনে একটি বিস্ফোরণ এবং একে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার যে চরম ঘাটতি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে, তা-ও চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে উন্নয়নকে। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের শব্দের তীব্রতা উন্নয়নের প্রপাগান্ডার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি তীব্র। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণ শুধু ভবনই ধ্বংস করেনি, ধ্বংস করেছে উন্নয়নের অহংকারকেও।

  • জাহেদ উর রহমান ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক