বিএনপি নির্বাচনে না গেলে কিছুই করার নেই!

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান এমন কিছু কথা বলেছেন, যা নিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। সম্ভবত পূর্বসূরির মতো তারাও একটি একতরফা নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খোলসা করে কিছু না বললেও হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনেক সময় তাদের কথায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে আনিছুর রহমান রংপুর সিটি নির্বাচনকে সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। খুবই ভালো কথা। রংপুর সিটি নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এমন দাবি কেউ করেননি। সেখানে একটি ভালো নির্বাচনের ‘কৃতিত্ব’ কমিশন নিতে পারে।

কিন্তু স্থানীয় সরকার সংস্থার কিংবা জাতীয় সংসদের একটি বা দুটি উপনির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের যে তুলনা হয় না ১০ মাস বয়সী কমিশন সেটা বুঝতে চায় না। রংপুর সিটি নির্বাচনটি সুষ্ঠু হলেও পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও মাঠে-ময়দানে বক্তৃতায় বলেন, বিএনপিই তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি দিবালোকের মতো সত্য হবে। বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। অন্তত গত চার দশকের রাজনীতির অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। সাবেক সেনা শাসক এইচ এম এরশাদ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় দলটিকে বি-টিম বলে উপহাস করেছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন আগে নির্বাচন করে বিরোধী দলে বসুন, তারপর এ টিম হওয়ার চেষ্টা করবেন। অথচ এরশাদের পদত্যাগের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপিই সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ যে সেই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারেনি, তার অন্যতম কারণ ছিয়াশির নির্বাচনে অংশ নেওয়া।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন রাজনীতি অস্থির তখন বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি উপনির্বাচন নিয়েও নানা তৎপরতা লক্ষ করছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তিনটিতে মনোনয়ন দিয়েছে। দুটি ছেড়ে দিয়েছে ১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে। বাকি তিনটির একটি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, যেখানে বিএনপির পদত্যাগী সংসদ সদস্য আবদুর সাত্তার ফের প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি দলও ছেড়েছেন। বাকি তিনটি আসন কি জাতীয় পার্টিকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে কি না রাজনৈতিক মহলে সেই আলোচনা আছে।

এবার অনেকগুলো দল বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, যার শেষ খেলাটি হয়েছে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যে। এর কোনো একটি দল অনুপস্থিত থাকলে বিশ্বকাপের যে চেহারা হতো, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কিংবা এর যেকোনো একটির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হওয়ার ফলাফলও অনুরূপ হবে। সেই নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধতা পেলেও জনরায়ের প্রতিফলন ঘটে না। বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই আইনগতভাবে অবৈধ বলে আদালত ঘোষণা করেননি। কোনো কোনো আইনকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করেছেন।

বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি হিসেবে নিলে রংপুর সিটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ বলতে হবে। তবে তবে অবাধ হয়নি। কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়াও একটি বাধা (যদি সেই দল নির্বাচনী ব্যবস্থায় অনাস্থা প্রকাশ না করে থাকে)। গাইবান্ধায় উপনির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল অংশ না নেওয়ার পরও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী জয়ের বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন না বলেই সেখানে নানা অঘটন ঘটিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত কমিশন নির্বাচনটি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। আনিছুর রহমান বলেছেন, ‘নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, ইসি সেটা করার চেষ্টা করে যাবে। কেউ যদি না আসে, তাদের আনতে আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, ইসি সেটা করবেও না। তবে তাঁরা আশা করেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।’

এখানে বোধ হয় আনিছুর রহমান একটি ভুল করে ফেলেছেন। নির্বাচনে কোনো দলকে আনার বাধ্যবাধকতা নেই বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তিনি আইনি ফাঁক বের করলেও নির্বাচনের যে উদ্দশ্যে তা অগ্রাহ্য করেছেন। নির্বাচন হলো জনপ্রতিনিধি বাছাই করার উন্মুক্ত প্রক্রিয়া। সেই বাছাইপ্রক্রিয়ায় কোনো স্তরে অনিয়ম হলে বাধা থাকলে সেটা দূর করাই কমিশনের দায়িত্ব।

মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি নির্বাচন কমিশন বা কোনো দল নয়। নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি হলো জনগণ। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক। তারা যদি এই মালিকানা অস্বীকার না করেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে মানেনি, কিংবা কমিশনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেনি, এ কারণে তাদের প্রতি আনিছুর রহমান ও তার সহযোগী কমিশনারদের গোস্সা থাকতে পারে। তাই বলে সংবিধানে বর্ণিত দায়িত্ব তাঁরা বিস্মৃত হতে পারেন না। আনিছুর রহমান বলেছেন, ‘তারা আমাদের অধীন একটা নির্বাচনেও অংশ নেয়নি। অংশ নিয়ে বলুক যে ভোট সুষ্ঠু হয়নি। তারা ডে ওয়ান থেকেই তো আমাদের মানছে না। আমাদের নিয়োগপ্রক্রিয়াই নাকি সুষ্ঠু হয়নি। আইনের আওতায় প্রথম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারপরও বলা হচ্ছে, আমাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া যথার্থ হয়নি।’

আনিছুর রহমানেরা বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের ইতিহাসটা একবার দেখে নিতে পারেন। বর্তমানে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছে বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগও অনুরূপ যুক্তি দিত। আবার এখন আওয়ামী লীগ নেতারা দলীয় সরকারের পক্ষে যেসব যুক্তি দিচ্ছেন বিএনপির নেতারা ক্ষমতায় থাকতে একই কথা বলতেন। আমাদের রাজনীতির যুক্তিগুলোও ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। এই সত্যটিও নির্বাচন কমিশনকে বুঝতে হবে।

আনিছুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জনগণ যাঁদের বিজয়ী করবে, তাঁরা জনপ্রতিনিধি হয়ে আসবেন, সরকার গঠন করবেন। কিন্তু নির্বাচনের আগেই যদি ফলাফল নির্ধারিত হয়ে থাকে, সেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া আর না নেওয়ার মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাদের চলতে হবে সূক্ষ্ম দড়ির ওপর পা দিয়ে। কোনো দিকে সামান্য হেলে পড়লে সারা জীবনের অর্জন ধুলোয় লুটিয়ে যাবে।

সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে বেশ সুনামই করেছিলেন। আরেক সিএসপি কর্মকর্তা কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিচারপতি আবদুর রউফও ১৯৯১ সালে কঠিন সময়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। তার সময়ই ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনে বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এক মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে না পেরে এখনো তাঁকে কঠোর সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। মাগুরা ঠেকাতে পারলে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আন্দোলন না-ও হতে পারত।

কাজী রকিব কমিশন পাঁচটি সিটি করপোরেশনে সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। পরে কিন্তু তারা জাতীয় নির্বাচনটি সবার অংশগ্রহণমূলক করতে পারেনি। কে এম নূরুল হুদা কমিশনও নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায় ভালো নির্বাচন করেছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে এসে তারা সবকিছু গুবলেট করে দেয়। আনিছুর রহমানেরা রংপুর ও কুমিল্লায় ভালো নির্বাচন করে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন। কিন্তু তাঁদের আসল পরীক্ষাটি হবে ২০২৪ সালে। সেই নির্বাচনে সব দল অংশ না নিলে সেটি আইনত গ্রহণযোগ্য হলেও নৈতিকতার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন রাজনীতি অস্থির তখন বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি উপনির্বাচন নিয়েও নানা তৎপরতা লক্ষ করছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তিনটিতে মনোনয়ন দিয়েছে। দুটি ছেড়ে দিয়েছে ১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে। বাকি তিনটির একটি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, যেখানে বিএনপির পদত্যাগী সংসদ সদস্য আবদুর সাত্তার ফের প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি দলও ছেড়েছেন। বাকি তিনটি আসন কি জাতীয় পার্টিকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে কি না রাজনৈতিক মহলে সেই আলোচনা আছে। কয়েক দিন আগে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানেও অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি উপনির্বাচন নিয়েও কথা হয় বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
নির্বাচন কমিশন কি ‘কেউ না এলে তাদের কিছু করার নেই’ নীতি নিয়ে এগোবে, না সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করে যাবে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।

    ইমেইল: sohrabhassan55@gmail.com