চা–শ্রমিকদের আইনগতভাবে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে
চা–শ্রমিকদের আইনগতভাবে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে

মতামত

চা–শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য অধিকারের চ্যালেঞ্জ

দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চা–শ্রমিকদের ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চা–শ্রমিকদের একাংশ এ মজুরি প্রত্যাখ্যান করে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। চা–শিল্পের মালিকপক্ষের দাবি, দৈনিক মজুরি কম হলেও চা–বাগানের শ্রমিকেরা অন্য অনেক সুবিধা পান। অস্বীকার করার উপায় নেই, চা–বাগানের জন্য লিজ নেওয়া সরকারি জমিতে আবাসনের সুযোগ, যাকে মাথা গোঁজার ন্যূনতম ঠাঁই বলা অত্যুক্তি হবে না, ছাড়া আরও কিছু সুবিধা মালিকপক্ষ দিয়ে থাকে। এসব ‘সুবিধা’র গুণগত মান সম্পর্কে বিস্তর ও বাস্তবসম্মত উদ্বেগ রয়েছে। যে বিষয় বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, তা হলো দৈনিক মজুরির সঙ্গে ওই সুবিধাগুলোর অর্থমূল্য বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের অন্যতম বিকাশমান ও লাভজনক এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মোট বাস্তব মাসিক বেতন কত হয় এবং সমপর্যায়ের অন্যান্য খাতের ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে তার তুলনামূলক অবস্থান কেমন। আর মজুরির বাইরে চা–শ্রমিকদের আইনসম্মত ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণের বাধ্যবাধকতার বিবেচনায় চা–শিল্পের মালিকপক্ষ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার বাস্তব চিত্রটিই–বা কেমন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ প্রকাশিত ‘চা–বাগানের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল চা–শ্রমিকের তৎকালীন দৈনিক আর্থিক মজুরি ১০২ টাকার সঙ্গে অন্যান্য সুবিধার অর্থমূল্য যোগ করলে মোট মাসিক সার্বিক মজুরি হয় ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানমতে ৫ হাজার ২৩১ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট অন্য সব খাতের তৎকালীন মজুরির ভেতর নিম্নতম।

২০১৮ সালের পর চা–শ্রমিকের দৈনিক মজুরি যেমন বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে, তেমনি অন্য সব খাতেই সর্বনিম্ন মজুরিও বেড়েছে। তদুপরি সেসব খাতে প্রায় সব ক্ষেত্রে মজুরির বার্ষিক বৃদ্ধির নিয়ম রয়েছে, যা চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। চা–শ্রমিকের অধিকারভিত্তিক বৃহত্তর চিত্র আরও হতাশাব্যঞ্জক। চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আইনগতভাবে ও আইনের নির্মম লঙ্ঘনের মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্যপ্রাপ্তি থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রম আইন অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি পঞ্জিকাবর্ষে পূর্ণ বেতনে ১০ দিনের যে নৈমিত্তিক ছুটি পেয়ে থাকেন, চা–শ্রমিকের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। অন্য সমপর্যায়ের খাতে প্রতি ১৮ কর্মদিবসের জন্য শ্রমিকেরা ১ দিন অর্জিত ছুটি পেয়ে থাকেন, যা চা–বাগানে ২২ দিন। অন্য খাতে দুই বছর চাকরি পূর্ণ হলে ভবিষ্য তহবিলে মালিকপক্ষের প্রদেয় অংশ সম্পূর্ণ পাবেন, চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা ১০ বছর। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফার ৫ শতাংশের ৮০ শতাংশ শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলে ও বাকি ২০ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে প্রদেয় হবে। কোনো চা–বাগানে এই নিয়ম মানা হয়, এমন কোনো তথ্য নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী যে গ্রুপ বিমার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা চা–বাগানে মানা হয় না। আইনানুযায়ী কোনো শ্রমিক তিন মাস সন্তোষজনক শিক্ষানবিশকাল অতিক্রম করার পর স্থায়ী হিসেবে নিয়োগ পাবেন, কিন্তু উল্লিখিত গবেষণায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে আওতাভুক্ত ৬৪টি বাগানের কোনোটিতেই তা মানা হয় না। কারণ, স্থায়ী হলে শ্রমিক নির্ধারিত মজুরিসহ অন্য সুবিধাসমূহ প্রাপ্য হবেন। স্থায়ী হওয়া শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না। নিয়োগপত্রের বিকল্প সি-ফরম দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ৯৩ শতাংশ স্থায়ী হিসেবে কর্মরত উত্তরদাতাকেই কোনো নিয়োগসংক্রান্ত নথি দেওয়া হয় না।

সর্বোপরি, চা–শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার হরণ ও চলমান বৈষম্যকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে, তা একদিকে মালিকপক্ষের প্রভাবশালী অংশের সংবেদনশীলতার ঘাটতি ও দীর্ঘকাল লালিত ঔপনিবেশিক মানসিকতা, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরএকাংশের শুদ্ধাচারের ঘাটতির সংমিশ্রণের ফল। একইভাবে চা–শ্রমিকদের পর্যাপ্ত শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি এবং মালিকপক্ষের সুচতুর বিভাজন কৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে চা–শ্রমিক ইউনিয়নের দর-কষাকষির দক্ষতার অভাবের কারণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা পদদলিত হয়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, খাবার পানি, স্যানিটেশন, দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ, অসুস্থতাজনিত ও মাতৃত্বকালীন ছুটি, উৎসব ভাতাসহ চা–শ্রমিকের অন্যান্য ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গুণগত মান বিবেচনায় বিরাজ করছে হতাশাজনক চিত্র। রয়েছে প্রতারণামূলকভাবে পাতার ওজন কম দেখানোসহ বিভিন্ন অজুহাতে কম মজুরি প্রদানের অভিযোগ।

শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি বাগানে খাওয়ার পানির সুব্যবস্থা থাকার কথা, কিন্তু কোনো বাগানেই এ জন্য প্রয়োজনীয় নলকূপ বা কুয়ার ব্যবস্থা নেই; অনেক ক্ষেত্রেই বাগানে প্রবহমান ছড়া, ঝরনা, খাল ইত্যাদি থেকে শ্রমিকদের পানি পান করতে হয়। বাগানের প্রতি সেকশনে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা নেই। জরিপকালীন যেসব নারী শ্রমিক গর্ভধারণ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই মাতৃত্বকালীন ছুটি পাননি। আর যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের একাংশ ছুটির সময় নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্য মজুরি পাননি। ৬৯ শতাংশ শ্রমিক জানান, তাঁদের যে রেশন দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। রেশন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী মালিকপক্ষ প্রত্যেক শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের জন্য বিনা মূল্যে বাসস্থান নিশ্চিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশ টি বোর্ডের তৎকালীন হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ৩২ হাজার ৯৯৯ স্থায়ী শ্রমিকের জন্য আবাসন বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। যাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁদের একটিমাত্র ঘরে কোনো বিভাজকের ব্যবস্থা না থাকায় মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ছেলের স্ত্রী এবং গরু-ছাগল নিয়ে পুরো পরিবারকে একসঙ্গে বসবাস করতে হয়।

বিধিমালা অনুযায়ী বাগানমালিকের নিজ উদ্যোগে বাগানপ্রতি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু গবেষণার আওতাভুক্ত ৬২ শতাংশ বাগানমালিক তা করেননি। প্রতিটি বাগানে হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম থাকলেও জরিপের আওতাভুক্ত ৬৪টি বাগানের মধ্যে ১১টিতেই তা ছিল না। বেশির ভাগ চা–বাগানের চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। নিয়ম অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকার কথা থাকলেও, বেশির ভাগ বাগানমালিক তা মানেন না।

সংশ্লিষ্ট সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে শুদ্ধাচারের ঘাটতি রয়েছে। বাগানমালিকপক্ষের প্রভাবশালী অবস্থান ও তার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবের যোগসাজশের কারণে তদারকি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একাংশের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনে বিরত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নিয়মিত বাগান পরিদর্শনের দায়িত্ব থাকলেও তা করা হয় না বললেই চলে।

সর্বোপরি, চা–শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার হরণ ও চলমান বৈষম্যকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে, তা একদিকে মালিকপক্ষের প্রভাবশালী অংশের সংবেদনশীলতার ঘাটতি ও দীর্ঘকাল লালিত ঔপনিবেশিক মানসিকতা, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরএকাংশের শুদ্ধাচারের ঘাটতির সংমিশ্রণের ফল। একইভাবে চা–শ্রমিকদের পর্যাপ্ত শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি এবং মালিকপক্ষের সুচতুর বিভাজন কৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে চা–শ্রমিক ইউনিয়নের দর-কষাকষির দক্ষতার অভাবের কারণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা পদদলিত হয়ে রয়েছে। চা–শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ আইনগত অন্যান্য অধিকার নিশ্চিতে বাগানমালিক ও সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান অধিকতর সংবেদনশীল ও মানবিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলে স্বল্প মেয়াদে তা মালিকপক্ষের জন্য লাভজনক হতে পারে, কিন্তু এ খাতের টেকসই বিকাশের বিবেচনায় তা হবে আত্মঘাতী।

ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি