‘কেন কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা কিংবা উত্তরবঙ্গ বন্যায় ডুবে গেলে বাংলাদেশ অন্ধ হয়ে যাও?’
‘কেন কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা কিংবা উত্তরবঙ্গ বন্যায় ডুবে গেলে বাংলাদেশ অন্ধ হয়ে যাও?’

গরিবের বন্যা বন্যা নয়, গরিবের কান্নাও কান্না নয়

বৈষম্যের তলানিতে পড়ে থাকা রংপুর বিভাগের চারটি জেলা—রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে বন্যা হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। বন্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভাঙন। এই বন্যা ও ভাঙন নিয়ে সরকার বিচলিত নয়। খরা, বন্যা, শীত—কখনোই এ অঞ্চলের কোনো দুর্যোগে সরকারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না।

কয়েক দিন আগে ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের জেলাগুলোয় খুব বন্যা হয়েছিল। তখন উপদেষ্টা পরিষদ খুব তৎপর ছিল। প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছিল সরকার। রংপুর অঞ্চলে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রসহ কয়েকটি নদীতে একই সময়ে ভয়াবহ ভাঙন ছিল। কিন্তু ভাঙনে দিশাহারা মানুষের খবর নেয়নি সরকার কিংবা অন্য কেউ।

ভরা বর্ষার বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ার পর পানি নেমে গেলে আবারও ফসল রোপণ করা হয়। কিন্তু এ সময়ে আর সেটি সম্ভব নয়। এখন যে ফসলের ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়। তিস্তা কিংবা ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী মানুষ একটি স্থায়ী সমাধান চায়

কয়েক মাস ধরে তিস্তাপারের কয়েকটি জেলায় অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলছে নদীভাঙনের শিকার অসহায় জনগণ। এই হাহাকার আমাদের নীতিনির্ধারকদের সামান্যতম স্পর্শ করেনি। আমি নিজেই সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলেছি, লিখিত দিয়েছি। এ অঞ্চলের কথা কে শুনবে? ভাঙনকবলিত এলাকায় তেমন কোনো সহায়তা পাঠানো হয়নি।

তিস্তাপারে কেবল গতিয়াশামে ১ হাজার ৭৫টি বাড়ি ছিল। গত ৪ বছরে তার ৮০০ বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এদের একজনকেও পুনর্বাসন করেনি সরকার। তিস্তাপারে এ রকম লাখ লাখ পরিবার বাস্তুহারা হচ্ছে। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য গণমাধ্যম তথা বিত্তশালীরা সোচ্চার হয়েছিল, এটি খুব ভালো। আমরা চাই, এই ভালো সবখানে হোক। দুঃখজনক হলেও সত্য, রংপুর অঞ্চলের জন্য কেউ নেই।

এ বছর বন্যার্তরা দেশবাসীর দুই রকম চেহারা দেখেছে। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য এক রকম সহৃদয়তা আর রংপুর অঞ্চলের বন্যার সময় কঠিন নীরবতা। রংপুর অঞ্চলের অনেকে এটি মেনে নিতে পারছে না। অনেকে ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘গরিবের বন্যা বন্যা নয়; গরিবের কান্নাও কান্না নয়। তিস্তায় গিয়ে বন্যার ঘোলা জলে, কান্নার লোনাপানিতে সেলফি খিচি, আসেন!’ এক তরুণ সূর্যখচিত সবুজ কাপড় চোখে বেঁধে রাজু ভাস্কর্যের সামনে একটি পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পোস্টার পেপারে লেখা, ‘কেন কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা কিংবা উত্তরবঙ্গ বন্যায় ডুবে গেলে বাংলাদেশ অন্ধ হয়ে যাও?’

রংপুর অঞ্চলে প্রতিবছর একাধিকবার বন্যা হয়। কোনো কোনো বছর মাসাধিক কাল বন্যা থাকে। এই বন্যার খবর জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো দু–একবার ঢাকা কিংবা সারা দেশ সংস্করণে দেয়। অধিকাংশ সময় এ খবর ছাপা হয় রংপুর কিংবা উত্তরাঞ্চল সংস্করণে। অধিকাংশ টেলিভিশনে বিকেলের গ্রাম-জনপদের খবরে এক–আধটু দেয়।

এ অঞ্চলের মানুষ অধিকাংশই গরিব। এ কারণে বন্যায় যে ঘরবাড়ি ডুবে যায়, তা টিনের চাল আর বাঁশের বেড়ার। গরিবের ডুবে যাওয়া টিনের ঘরবাড়ি বিত্তশালীদের অনুভূতিকে আলোড়িত করে না। নদী যখন ভাঙে, একবারে কয়েক শ বাড়ি ভাঙে না। ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে। সে কারণে হয়তো ভয়াবহতা কাউকে স্পর্শ করে না। অথচ ভাঙনে যে ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।

রংপুরের চার জেলায় এখন যে বন্যা হচ্ছে, তা বৈষম্যপূর্ণ আচরণের পরিণতি। পর্যাপ্ত টাকা দিয়ে নদীর পরিচর্যা করলে কম পানিতে বন্যা হতো না। দেশবাসী খুব ভালো করেই জানে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সব বছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রংপুরের জন্য নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলকে দেশের সবচেয়ে গরিব অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় যে বন্যা হয়েছে, তা এ নদীর কোনো পরিচর্যা না করার কারণে।

তিস্তা নদীর পরিচর্যার দাবিতে দেশের সবচেয়ে বড় আন্দোলন চলমান। তিস্তাপারের মানুষ আর কিছুতেই তিস্তার অভিশাপ নিতে পারছে না। খরা-বর্ষায় নদীটিকে শত্রুতে পরিণত করা হয়েছে। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র মিলে একটি বড় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা উচিত ছিল আরও অনেক আগে। সরকার আসে, সরকার যায়। এ অঞ্চলের সঙ্গে সরকারের বৈষম্যনীতি বদলায় না।

নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে। এ কারণে সামান্য পানিতে নদীর পাড় উপচে পানি চলে যায় পার্শ্ববর্তী জনপদে। তিস্তার শাখা নদীগুলোর মুখ বন্ধ করা হয়েছে। এই নদীগুলো তিস্তার প্রচুর পানি বহন করত। উৎসমুখ ফসল রক্ষা বাঁধের নামে নদীগুলোকেই মেরে ফেলা হয়েছে। এ রকম অনেক শাখা নদী আছে, যেগুলোর একটিও আর সচল নেই। ফলে তিস্তা নদীর সবটুকু পানি একটি প্রবাহ দিয়েই বাংলাদেশে বয়ে চলে।

বর্তমানে যে বন্যা হলো, এই বন্যার ক্ষতি আর পূরণ করার মতো নয়। আশ্বিনে যে ফসলের ক্ষতি হবে, তা আর নতুন করে ফলানো যাবে না। ভরা বর্ষার বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ার পর পানি নেমে গেলে আবারও ফসল রোপণ করা হয়। কিন্তু এ সময়ে আর সেটি সম্ভব নয়।

এখন যে ফসলের ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়। তিস্তা কিংবা ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী মানুষ একটি স্থায়ী সমাধান চায়। বৃষ্টি অস্বাভাবিক বেশি হলে প্রাকৃতিকভাবে বন্যা হবে। কিন্তু নদীর পরিচর্যা করলে যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা কেন করা হবে না? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নদীগুলোর পরিচর্যা করা হয়নি, ফলে বন্যা রোধ করা সম্ভব হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার তো বৈষম্যবিরোধী সরকার। তারা কি রংপুর অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে?

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক