মতামত

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আমদানিনির্ভরতা কীভাবে কমবে

বিদ্যুৎ খাতের কলেবর দিন দিন বাড়ছেই। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে আরও প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট।
ছবি : প্রথম আলো

আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে দেশে ডলারের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি করতে বিধিনিষেধ জারি করেছে। বর্তমানে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ওঠানামা করছে। অন্যদিকে, আমদানি সংকোচন নীতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও প্রয়োজনের তাগিদেই আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এখন সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে ন্যূনতম বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ৬০ শতাংশ আমদানিনির্ভর জ্বালানির (তেল, এলএনজি, কয়লা) জোগান অব্যাহত রাখা।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের মূল্য প্রায় দেড় গুণ বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে এলএনজি ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতার হার তেলের চেয়ে অনেক বেশি। এমনিতেই তো দিন দিন চাহিদা বৃদ্ধির কারণে তেল, এলএনজি ও কয়লা বেশি পরিমাণে আমদানি করতে হচ্ছে; তারপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে এগুলোর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও উচ্চ পরিবহন ব্যয়।

যথেষ্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও বস্তুত আমদানিনির্ভর তেল, এলএনজি ও কয়লা সংগ্রহে সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে ১০০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করতে হচ্ছে। ডলার-সংকটে এসব জ্বালানি ঠিকভাবে আমদানি করতে না পারায় সরবরাহ ও চাহিদার বিস্তর পার্থক্য দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুতের আংশিক চাহিদা মেটানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। তারপরে শীত আসবে, চাহিদা কমবে, লোডশেডিং থেকে আবার মুক্তি পাবে দেশ। আসলে কি ভবিষ্যতে আমাদের আর জ্বালানিসংকট হবে না, নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ আমরা নিশ্চিত করতে পারব পরবর্তী সময়ে?

প্রতিবার বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) কোন গবেষক, শিক্ষক কিংবা পেশাজীবীর সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে, তা আমার জানা নেই। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নিজস্ব জনবল দ্বারা মহাপরিকল্পনা তৈরি সম্ভব হলো না? আমদানিনির্ভর জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাত ও মহাপরিকল্পনা করতে যারা বাধ্য করছে, তাদের পরিহার করে এ খাতকে কীভাবে স্বনির্ভরতার দিকে অগ্রসর করা যায়, তা ভেবে দেখা জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ এ খাতকে হুমকির মুখে রেখে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট নেই বলে আজ আমাদের এ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। পোশাকশিল্পকে আমরা আর কত দিন ধরে রাখতে পারব? দক্ষ শ্রমিক তৈরি না করে এভাবে চললে প্রবাসী আয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভেবে দেখা দরকার। ১৮ কোটির এই জনবহুল দেশে দিন দিন চাহিদা তো বাড়বেই। তাহলে আমরা কি কিছু সুবিধাভোগীর সুবিধার জন্য লাগামহীন আমদানির দিকে যাব, নাকি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়নের জন্য অবকাঠামোর দিকে নজর দেব? আমার লেখার মূল বিষয় হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে পুরোপুরি আমদানিনির্ভরতা থেকে কিছুটা কমিয়ে কীভাবে নিজের পায়ে কিছুটা হলেও দাঁড়ানো যায়? প্রথমে আসা যাক জ্বালানি খাতে।

বাপেক্সকে শক্তিশালী করে গ্যাস আহরণের লক্ষ্যে স্থল ও জলে অনুসন্ধান বাড়াতে হবে। যেকোনো মূল্যে মজুতকৃত দেশীয় কয়লা ব্যবহার করতে হবে। তেল, গ্যাস ও কয়লার অপচয় রোধে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। মাস ট্রানজিটের মাধ্যমে সেবার পরিধি বাড়িয়ে ছোট ছোট বাস ও ব্যক্তিপর্যায়ের গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহার বাড়াতে হবে। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেতে হবে দ্রুত, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সংস্কৃতিতে জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে।

বিদ্যুৎ খাতের কলেবর দিন দিন বাড়ছেই। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে আরও প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলে মোট ১৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ২০৩০ সালে এই কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি, যেমন বাষ্পীয় জেনারেটর, টারবাইন, অলটারনেটর, ট্রান্সফরমার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার ইত্যাদি পৃথিবীর বিখ্যাত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, যেমন জেনারেল ইলেকট্রিক, সিমেন্স, মিতসুবিশির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই চুক্তি করে প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে ভারত সরকার বেইল নামক রাষ্ট্রীয় ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান বানিয়ে এখন নিজেরাই এসব যন্ত্রপাতি তৈরি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে, আবার বিদেশেও রপ্তানি করছে। এখন তাদের ৮৬টি দেশে শাখা-প্রশাখা অফিস রয়েছে।

বুঝলাম ভারত অনেক বড় দেশ, তাদের রয়েছে অনেক কাঁচামাল, প্রযুক্তি ও চাহিদা; কিন্তু আমাদের চাহিদার আকারও তো বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহজেই তৈরি করতে পারি বাষ্পীয় জেনারেটর, ট্রান্সফরমার, পাম্প ও কুলিং টাওয়ার। ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার তো দেশের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভালোভাবেই তৈরি করছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে এবং কর্মসংস্থানও হচ্ছে। আগে তো সব ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এসব যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য যে প্রযুক্তি দরকার, তা আমাদের প্রকৌশলীরা ভালোভাবেই পারবেন। ভারত ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কী করা দরকার, তা সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সঠিক কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেন। এখন বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্ট বেসরকারি নির্মাণপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করি, যাতে তারা এগিয়ে আসে।

এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম আছে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের সক্ষম কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে কাঁচামাল বিনিময়, প্রযুক্তি রপ্তকরণ ও হস্তান্তরের কথা ভাবা যায়। প্রক্রিয়াটি সহজ ও টেকসই হবে বলে আমার মনে হয়। বিদ্যুতের উৎপাদন খাতটি শতভাগ আমদানিনির্ভর। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণ খাতটিও যারা যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে, তারাই তা করে থাকে। এতে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রিজার্ভ ব্যয় করতে হয়। পদ্মা সেতু আমাদের প্রকৌশলীরা করতে পারলে এসব যন্ত্রপাতি আমাদের প্রকৌশলীরা নির্মাণ করতে পারবে না কেন? জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা। এ খাতে সব অংশীজনের দেশীয় মনোবৃত্তি লালন ও ধারণ, দায় মুক্তি আইন রহিতকরণ, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষ্ঠু ও সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। দরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান। তাহলেই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান অবশ্যই সফল হবে।

প্রতিবার বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) কোন গবেষক, শিক্ষক কিংবা পেশাজীবীর সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে, তা আমার জানা নেই। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নিজস্ব জনবল দ্বারা মহাপরিকল্পনা তৈরি সম্ভব হলো না? আমদানিনির্ভর জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাত ও মহাপরিকল্পনা করতে যারা বাধ্য করছে, তাদের পরিহার করে এ খাতকে কীভাবে স্বনির্ভরতার দিকে অগ্রসর করা যায়, তা ভেবে দেখা জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ এ খাতকে হুমকির মুখে রেখে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।

মো. শফিকুল ইসলাম অধ্যাপক নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।