আগে বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণা, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞানশিক্ষা আর গবেষণায় আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়েই খোলা হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলো। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় মানের চেয়ে সংখ্যাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়োটেকনোলজি বিষয়ে মোট ৯৪৫ জন স্নাতক বের হন। কিন্তু গত এক বছরে মাত্র তিনটি বায়োটেকনোলজি–সংশ্লিষ্ট চাকরির বিজ্ঞাপন ছিল, যার মধ্যে আবার একটিতে বায়োটেকনোলজি থেকে পাস করা ছেলেমেয়েদের নেওয়াই হয়নি।

অন্যদিকে পাঁচ শতাধিক প্রাণরসায়ন–সংশ্লিষ্ট গ্র্যাজুয়েট তৈরি হয় দেশে কিন্তু ৫০টি পদও খালি নেই এ বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একের পর এক খুলছে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেকাট্রনিকসের মতো বিষয়। কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত করতে পেরেছি তাঁদের কর্মক্ষেত্র?

আমরা বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে চাই। আমরা চাই একজন শিক্ষার্থী এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি করে এই দেশে বসেই একদিন টিকা তৈরি করুন। আমাদের সমস্যা আমাদের বিজ্ঞানীদেরই সমাধান করতে হবে। আর কেউ এসে তা করে দিয়ে যাবে না

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, আবিষ্কারের সৌন্দর্য আর সৃষ্টিশীলতাকে উদ্‌যাপনের জন্য প্রতিবছর ১০ নভেম্বর পালিত হয় বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস। কিন্তু বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা কোন পথে  হাঁটছি? মানসম্পন্ন বিজ্ঞানী তৈরির চেষ্টা না করে, বিজ্ঞানের কর্মক্ষেত্র তৈরি না করে আমরা যেখানে–সেখানে সব অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল বিজ্ঞানের বিষয় পড়ানোর অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে অথচ চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে একবারেও ডিএনএ নিয়ে কোনো ব্যবহারিক ক্লাস বা কাজের অভিজ্ঞতা হয়নি এ রকম অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজের অভিজ্ঞতায় দেখে এসেছি। মেকানিক্যাল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে কিন্তু এখনো সংশ্লিষ্ট অর্ধেক বিষয়ের ল্যাবরেটরি নেই, এ রকম প্রতিষ্ঠানও আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জীববিজ্ঞান, কৃষি ও প্রকৌশলের বিষয়গুলোতে অন্য সব বিষয়ের ২০ গুণ অনুদান দেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন! সাহিত্য আর জিনোম সিকোয়েন্সিং দুটি ভিন্ন জগতের বিষয়।

কিন্তু দুটির জন্য সমান বরাদ্দ দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। নেই পর্যাপ্ত গবেষণাগার, নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, তারপরও কেন অনুমতি দেওয়া হচ্ছে বিজ্ঞান–সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে? কেন দুই বা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে অনুমতি দিয়ে আগে তাদের পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে দেখা হচ্ছে না কেমন জনবল তৈরি হয়? ২০১০ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে মাত্র ১০টি ফার্মেসি স্কুলকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এ বিষয়ে পড়ানোর। এর একটাই কারণ, এ বিষয়ে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত না করে কাউকে পড়াতে দেওয়া হবে না। কারণ, এটি সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়।

বিজ্ঞানক্ষেত্রে একটি আশার কথা হলো গত ১০ বছরে বিজ্ঞানীদের গবেষণা বরাদ্দ বেড়েছে কয়েক গুণ। বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, ইউজিসিসহ বিভিন্ন সংস্থা এখন অনেক বিজ্ঞানী এবং গবেষককে অনুদান দেয়। কিন্তু এ অনুদানের টাকার পরিমাণ মাঝেমধ্যে এতই অল্প থাকে যে তা দিয়ে প্রকল্পের যন্ত্র কেনা তো দূরের কথা, রাসায়নিক সব কাঁচামালই কেনা সম্ভব হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাত্র দুই থেকে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়।

কেউ যদি জিনোম বা প্রোটিন বা খাবারের মান নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাঁর কাজের কাঁচামালের ২০ ভাগও এ অল্প পরিমাণ অর্থ দিয়ে কেনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুদানগুলো কী এক অদ্ভুত কারণে দুই বা তিন বছর গড়িয়ে যায়, তা–ও আবেদনের ফলাফল আসে না। চিকিৎসকদের অনেকেই হতাশ। সমসাময়িক গবেষণার প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়া হলে তার ফলাফল দেওয়া হয় তিন বছর পর, যখন সেই গবেষণার কোনো মূল্য থাকে না।

জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণায় প্রয়োজন বিশেষ প্রণোদনা। দেশের হাজারখানেক খুব ভালো গবেষক আছেন, এ বিষয় সংশ্লিষ্ট কিন্তু অনুদান পাচ্ছেন কয়েকজন। মলিকুলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি উদ্ভাবন, কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ক্যানসারের জিনগত ভিত্তি নিয়ে গবেষণা, সংক্রামক রোগের বিস্তার নিয়ে গবেষণা—এসব কাজকে অনেক বেশি গুরুত্ব ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা উচিত।

স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞানশিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হলো আমরা বিজ্ঞানশিক্ষাকে স্কুল পর্যায়ে আকর্ষণীয় করতে পারিনি। পেশা হিসেবে বিজ্ঞানী বা গবেষককে এখনো আকর্ষণীয় ও মর্যাদার একটি জায়গায় স্থান দিতে পারিনি সামাজিকভাবে। দেশের গবেষকদের বেতন ন্যূনতম। বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সাদামাটা বেতন দেওয়া হয় বিজ্ঞানীদের, নেই তেমন প্রণোদনা, অনেক ক্ষেত্রে পদোন্নতি অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। এমন অবস্থায় মেধাবীরা এ জায়গাগুলোয় চাকরি করতে আগ্রহ বোধ না–ও করতে পারেন। অন্যদিকে সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক বাজেট থাকা সত্ত্বেও তাঁদের থেকে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা বা গবেষণাপত্র বা উদ্ভাবন বা সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি বেরিয়ে আসছে না—এ রকম অভিযোগ আজকাল নিয়মিতভাবে পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবছর অন্তত একটি উচ্চ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বা উচ্চমানের জার্নালে প্রকাশ করতে হবে, এমন শর্ত জুড়ে দেওয়া যায় এবং এ রকম মানসম্পন্ন গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত।

বিজ্ঞানকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে উঠে আসা। একজন বিজ্ঞানীর কাজ যেমন নতুন আবিষ্কার করা, তেমনি অন্যদিকে সমস্যা চিহ্নিত করা ও তার সমাধানের পরামর্শ দেওয়া তাঁর কাজ। এটি কোনো অপরাধ নয়, এটি তাঁর নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশের জনগণের টাকায় যেহেতু একজন বিজ্ঞানী গবেষণা করেন, তাই তাঁর গবেষণার ফলাফল জানাটা অনেকটা জনগণের অধিকারের পর্যায়ে পড়ে।

গণমাধ্যমে কোনো বিজ্ঞানীকে কোনো সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য যদি অপমান করা হয়, বিব্রত করা হয়, তাঁর কাজকে অবমূল্যায়ন করা হয়—তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী তৈরি হবে না। সবাই করপোরেট কিংবা বেতনভুক্ত সাধারণ আটটা থেকে পাঁচটা অফিসের চাকরি খুঁজবেন। একজন বিজ্ঞানী কী নিয়ে গবেষণা করবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। এটা নির্ভর করে তাঁর দক্ষতা আর আগ্রহের ওপর।

আমরা বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে চাই। আমরা চাই একজন শিক্ষার্থী এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি করে এই দেশে বসেই একদিন টিকা তৈরি করুন। আমাদের সমস্যা আমাদের বিজ্ঞানীদেরই সমাধান করতে হবে। আর কেউ এসে তা করে দিয়ে যাবে না।

  • আদনান মান্নান অধ্যাপক ও গবেষক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

    ইমেইল: adnan.mannan@cu.ac.bd