মতামত

মাননীয় মন্ত্রী, একটু কমাবেন কি গরুর মাংসের দাম?

গরুর মাংসসহ প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। ঢাকায় আট শর নিচে গরুর মাংস নেই বললেই চলে।
ফাইল ছবি

সুরমা আক্তার পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের একটি কলেজে চাকরি করেন। কলেজ শেষে বাসায় ফেরার পথে শুনতে পান, নয়াবাজার এলাকায় ‘সুলভ’ মূল্যে গরুর মাংস, মুরগির মাংস, দুধ ও ডিম বিক্রি হচ্ছে। বাসায় না ফিরে ২০ মিনিট হেঁটে তিনি গেলেন নয়াবাজার। কিন্তু সেখানে কোনো ভ্রাম্যমাণ গাড়ি দেখতে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। পথে তাঁতীবাজার মোড়ে দেখতে পেলেন ভ্রাম্যমাণ গাড়িটি।

সুরমা আক্তার এক কেজি গরুর মাংস কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে গরুর মাংস, মুরগির মাংস সব শেষ। পরে তিনি তিন প্যাকেট দুধ নিয়ে বাসার পথ ধরেন।

গত বছরের দ্বিতীয় রোজার দিনের চিত্র এটি। সুরমা আক্তারের এই গল্প প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। গত বছর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এ কার্যক্রম তীক্ষ্ণভাবে নজর রেখেছিলাম একজন সাংবাদিক হিসেবে। গত বছর প্রায় প্রতিদিনই এ রকম অসংখ্য সুরমা আক্তারের গল্প রচিত হয়েছিল।

এ বছরও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ‘সুলভ’ মূল্যে মাংস, ডিম, দুধ সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছে। প্রথমত, এ বছরও রমজানে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে উদ্যোগটি অব্যাহত রাখায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে। এর আগে গত বছরের চিত্রটি পাঠকদের একবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক।

২.

গত বছর রাজধানীর ১০টি স্থানে ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে উল্লিখিত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করেছিল প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। পরে অবশ্য আরও চার–পাঁচটি স্থান বাড়ানো হয়েছিল। গত বছর একটা গাড়িতে গরুর মাংস ৫০ কেজি, মুরগির ড্রেসিং মাংস ২৫ কেজি, খাসির মাংস ৪ কেজি, ১ কেজির প্যাকেটে ২০০ কেজি দুধ এবং ১ হাজার ২০০টি ডিম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। গতবার গড়ে একটি স্থানে লাইনের প্রথম ৪০ থেকে ৪৫ জন মাংস কেনার সুযোগ পেয়েছিলেন। একটি ভ্রাম্যমাণ গাড়ির ক্যাশিয়ার বলেছিলেন, মাংস অন্তত আরও ১০ কেজি বাড়িয়ে দিলে কেউ বঞ্চিত হতো না।

গত বছর গরুর মাংস প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা, পাস্তুরিত তরল দুধ প্রতি লিটার ৬০ টাকা, খাসির মাংস প্রতি কেজি ৮০০ টাকা, ড্রেসড ব্রয়লার মাংস প্রতি কেজি ২০০ টাকা ও ডিম প্রতি হালি ৩০ টাকায় বিক্রি করেছে তারা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যে দাম নিচ্ছে, তা বাজারের দামের চেয়ে খুব বেশি যে কম, তা বলা যাচ্ছে না।

গতবারের দামে এবার এসব খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে পারবে না অধিদপ্তর। কারণ, গরুর মাংসসহ প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। ঢাকায় আট শর নিচে গরুর মাংস নেই বললেই চলে। খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকা। তরল দুধ প্রতি লিটার ৯০ টাকা, ডিমের ডজন ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইফতেখার হোসেন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম তাঁরা ধরছেন ৬৪০ টাকা। আর খাসির মাংস ৯৪০ টাকা। ড্রেসড ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ৩৪০ টাকা, প্রতি লিটার দুধ ৮০ টাকা এবং প্রতিটি ডিম ১০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে।

এবার ২০টি স্থানে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে। এর জন্য অধিদপ্তরকে আরেকবার ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে। কিন্তু পণ্যের পরিমাণ যেন কমানো না হয়। সাধু সাবধান!

৩.

সার্বিকভাবে উদ্যোগটি ভালো। তারপরও পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যে দাম নিচ্ছে, তা বাজারের দামের চেয়ে খুব বেশি যে কম, তা বলা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মূলত মধ্যবিত্ত বা বড়জোর নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা এই পণ্যের ক্রেতা। ক্রেতাদের অবয়ব, পোশাক-আশাকে তা স্পষ্ট। কোনো গরিব মানুষ, লুঙ্গি পরা রিকশাওয়ালা বা পোশাককন্যার পক্ষে ৬৪০ টাকা করে গরুর মাংস, ৩৪০ টাকা দরে ব্রয়লার মুরগির মাংস কিনে খাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই শ্রেণির জন্য শ ম রেজাউল করিমের এই মন্ত্রণালয় কি পদক্ষেপ নিতে পারে? গরুর মাংসের দাম ৫৫০ থেকে ৬০০–এর মধ্যে রাখতে পারে না? একইভাবে কমানো দরকার মুরগি, দুধ, ডিমের দামও। তৃতীয়ত, এই ‘সুবিধা’ কি কেবল রাজধানীর বাসিন্দারাই প্রাপ্য হবেন? ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১৬ কোটি তো রাজধানীর বাইরে বসবাস করেন। অধিদপ্তরের প্রতি আগামী বছর ঢাকার বাইরে বড় শহরগুলোতে এই কার্যক্রম পৌঁছানোর পরামর্শ থাকবে।

পুরো বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার রাতে কথা বলেছিলাম এস এম নাজের হোসাইনের সঙ্গে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের এই সহসভাপতি বললেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই কাজের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বাজারে একটা প্রভাব ফেলা। যেহেতু প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাজার থেকে কিছু কম দামে পণ্য বিক্রি করছে, তাই এর একটা প্রভাব বাজারে পড়ুক। বাজারের সাধারণ ব্যবসায়ীরা, যারা হুটহাট দাম বাড়িয়ে দেয়, তারাও একটু চিন্তার মধ্যে থাকুক। রোজার এই সময়ে তারা অতিরিক্ত দাম বাড়ালে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে, গিয়ে দাঁড়াবে প্রাণিসম্পদের ট্রাকের লাইনে—এমন একটা ‘ভয়ের’ মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা থাকুক। নাজের হোসাইন বলছেন, তা না হলে এ উদ্যোগের স্থায়ী কোনো তাৎপর্য নেই।

এস এম নাজের হোসাইনের এ বক্তব্যের সঙ্গে আপাতত দ্বিমত প্রকাশের কোনো কারণ দেখছি না। দেখা যাক, এবার কীভাবে কাজটি এগোয়। গতবারের মতো নজর রাখব। তারপর না হয় আরেকবার কলম ধরা যাবে!

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    alim.zaman@prothomalo.com