মতামত

ঢাকা–১৭ উপনির্বাচন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল

ভোটারের অপেক্ষা। ঢাকা–১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম
ছবি: প্রথম আলো

আমি নিজে ঢাকা-১৭ আসনের একজন ভোটার। এই আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই স্বাভাবিক কারণেই এই ভোট নিয়ে আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকে ভোটও দিয়েছি।

আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণ ২০০৮ সালের পরে ২০১৮–তে ভোট দিতে পেরেছিলাম। ২০১৪ সালে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। কেন্দ্রটি আমার বাসার কাছে ডিওএইচএস মহাখালীর বিআইএসসি স্কুলে। এখানে প্রায় ৩ হাজার ৩০০–এর বেশি ভোটার ছিলেন।

ঢাকা–১৭ আসনটি অনেকের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এই আসনের কিছু অঞ্চলে যে শুধু উচ্চ, উচ্চমধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বাস তা–ই নয়, তেমনি এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে, যেখানে নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ এবং ভোটারের বাস। তা ছাড়া এ অঞ্চলে রয়েছে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী সদর দপ্তর, রজনীগন্ধা সুপার মার্কেটসংলগ্ন ঘনবসতি এলাকা।

রয়েছে তিনটি সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত (অবশ্য এখন প্রায় সবাই অবসরপ্রাপ্ত) কর্মকর্তাদের ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি। এমন একটি আসন বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। এর বাইরে কূটনৈতিক পাড়া এ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার ভোট সরাসরি তাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকে। এই নির্বাচন নিয়ে আমরা আগ্রহের সবচেয়ে বড় কারণ সেনানিবাস এলাকায় থাকার কারণে আমি সিটি নির্বাচনেরও ভোটার নই। শুধু এই একটি নির্বাচনেই আমি ভোট দিতে পারি।

এসব মাথায় রেখেই ১৭ জুলাই উপনির্বাচনে ভোট দিতে গিয়েছিলাম বেলা তিনটার সামান্য পরে। শুধু ভোট দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য ছিল না, ভোটের পরিসংখ্যান আঁচ করার লক্ষ্য নিয়ে ওই সময় বেছে নিয়েছিলাম। যেহেতু এখানে কথিত কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার বা কথিত রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে সরকারি দলের কথিত কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ কমিটির (প্রার্থী জনাব মোহাম্মদ এ আরাফাতের বক্তব্য মোতাবেক) কোনো উৎপাত বা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে ঢোকার সময় যাচাই-বাছাই বা মারধর করার মতো দলীয় কর্মী ছিল না।

তাই পরিবেশ একেবারেই শান্ত ছিল। আমার ভোট দেওয়ার পর প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মুখেই শুনলাম ওই সময় পর্যন্ত (তিনটার পর) ৬ দশমিক ১২ শতাংশ ভোট পড়েছে। তাঁর মতে, আর এক ঘণ্টায় হয়তো কিঞ্চিৎ বেড়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ হলেও হতে পারে। কিন্তু আমি বের হওয়ার পরে আর কোনো ভোটারকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেখিনি। এখানে নারী ও পুরুষ কেন্দ্র রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে যাঁরা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব ছিলেন বা থাকবেন, তাঁদের জন্য আত্মবিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আগেও বলেছি, আবারও বলি, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ইতিমধ্যেই ভূরাজনীতির আবর্তে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একটি গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে দেশ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, যা সাধারণের কাম্য নয়। এখানে শুধু রাজনীতিবিদই নন, নাগরিক সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণ ও আমলাদেরও উপলব্ধি প্রয়োজন।

বেলা একটা পর্যন্ত এমনি ভোটারবিহীন ছিল শাহিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কেন্দ্রসহ সেনানিবাস ও মানিকদীর কেন্দ্রগুলোও। এমনকি আমার পরিচিত যাঁরা বনানীর বিদ্যানিকেতনে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞাও একই। পরে সেই কেন্দ্রে নির্দলীয় প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

নৌকার ব্যাজধারী সরকারি দলের কর্মী–সমর্থকদের হাতে তিনি লাঞ্ছিত হন বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে আমরা জানতে পারি। পুরো ঘটনায় পুলিশ যে ভূমিকা পালন করেছে, তা ছিল অগ্রহণযোগ্য। দায়িত্বে অবহেলার জন্য ওই কেন্দ্রের পুলিশের বিরুদ্ধে আরপিও অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি।

আগে আমার বিভিন্ন লেখায় নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলাম যে সিসিটিভির ব্যবহার শুধু ভেতরেই নয়, ভোটকেন্দ্রের প্রবেশমুখেও রাখতে। কারণ, ভোটকেন্দ্রের প্রবেশপথ পাহারা দেওয়া বা কোনো কমিটির উপস্থিতি নির্বাচনী আইনের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষ ভোটারদের হয়রানি করার মতো ঘটনা অহরহ ঘটে আসছে। অস্বস্তিতে পড়েন নারী ভোটাররা।

কিন্তু মনে হয় এটাই এখন চিরাচরিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক হয়, তখন কেন্দ্রের মুখেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং যার কারণে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতেই ভয় পাবেন। শেষের দিকে ব্যালটে সিল মারা শুরু হবে, যা এখনো হচ্ছে।

ঢাকা-১৭ আসনে ভোট পরিস্থিতি ছিল শান্ত ও নিরুত্তাপ। ভোটারদের এই অনাগ্রহ শেষ পর্যন্ত ছাপিয়ে গেছে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায়। যে উপনির্বাচনে সরকারি দলের প্রতিপক্ষই ছিল না, সেখানে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।

বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক্‌–নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল যখন দেশে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এরই মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দ্রুত তদন্ত করে নির্বাচনী আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া না হলে কমিশনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এ ঘটনার ফলাফল যেন বরিশাল বা গাইবান্ধার মতো না হয়।

নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতির এমন হার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পর্যবেক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী ৬-৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা। সেখানে শেষের দিকে ভোট বাড়ার কারণ নিয়ে পত্রপত্রিকায় নানা ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে।

এমন গুরুত্বপূর্ণ আসনে ইতিহাসের সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতি নিয়ে আমার নিজের বিশ্লেষণে তাৎক্ষণিক কিছু কারণ মনে হয়েছে। এক. প্রার্থী হিসেবে জনাব মোহাম্মদ এ আরাফাত মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত।

এমন প্রার্থী আমাদের কাম্য হলেও এ অঞ্চলের ভোটার, এমনকি তাঁর দলের কর্মীদের কাছেও তিনি তেমন পরিচিত নন। কারণ, তিনি মাঠের রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না। তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন ‘এলিটিস্ট’ পদ্ধতিতে ওপর থেকে। হয়তো এখানে অনেক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা ছিল।

দুই. নির্বাচনে কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। ফলে ভোটাররা আকৃষ্ট হননি। আরাফাতের প্রতিপক্ষ না হলেও নানা কারণে হিরো আলম সামান্য চমক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং উপনির্বাচন অনেক দিন ধরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন অবস্থায় রয়েছে। পছন্দমতো প্রার্থী না থাকায় এবং বিরোধী দলের সমর্থন না থাকায় ভোটার উপস্থিতি কমতে থাকে।

তিন. এ উপনির্বাচন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে হওয়ায় ভোটার, এমনকি দলীয় সমর্থক ভোটাররাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

চার. সর্বশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে ধস নেমেছে, তাতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভোটের প্রতি এ ধরনের অনাগ্রহ জন্মেছে। আমাদের গণতন্ত্রের জন্য এটা চরম ক্ষতিকর।

নির্বাচন কমিশন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে যাঁরা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব ছিলেন বা থাকবেন, তাঁদের জন্য আত্মবিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আগেও বলেছি, আবারও বলি, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ইতিমধ্যেই ভূরাজনীতির আবর্তে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একটি গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে দেশ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, যা সাধারণের কাম্য নয়। এখানে শুধু রাজনীতিবিদই নন, নাগরিক সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণ ও আমলাদেরও উপলব্ধি প্রয়োজন।

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

  • hhintlbd@yahoo.com