ট্রুং মাই ল্যান
ট্রুং মাই ল্যান

মতামত

ব্যাংক কেলেঙ্কারি: ভিয়েতনামে বিচার হয়, বাংলাদেশে কেন ছাড় পায়

আর্থিক খাতে জালিয়াতি বা মালিকপক্ষের লুটপাট নতুন কোনো ঘটনা নয়। আমার আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং জীবনে ভারত, ইতালি, মেক্সিকো, এমনকি আরব আমিরাতসহ অনেক দেশেই বিরাট বিরাট আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা দেখেছি।

সম্প্রতি আমরা জেনেছি, ভিয়েতনামের নারী ধনকুবের ট্রুং মাই ল্যানকে আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন দেশটির আদালত। ১১ বছর ধরে দেশটির বড় একটি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার লুট করার দায়ে তাঁকে এই সাজা দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা।

ট্রুং মাই ল্যানের বিরুদ্ধে দেশটির সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, ঋণের ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার পুনরুদ্ধার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই মামলায় ২ হাজার ৭০০ জনকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। এটির সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের ১০ জনসহ মোট ২০০ জন আইনজীবী ছিলেন।

এই মামলার প্রমাণ মোট ১০৪টি বক্সে সংরক্ষিত আছে, যার ওজন ৬ টন। মামলায় ট্রুংসহ মোট ৮৫ জনের বিচার চলছে, যাঁদের সবাই নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও করতে পারেন।

তবে আদালতে আসামিদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চারজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অন্যদের শর্ত সাপেক্ষে ৩ থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ট্রুং মাই ল্যানের স্বামীর ৯ বছর ও ভাইয়ের মেয়ের ১৭ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নগুয়েন ফু ট্রংয়ের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত এই বিচারকাজ সবচেয়ে নাটকীয়। তিনি মনে করেন, চরম দুর্নীতির কারণে জনগণের ক্ষোভ কমিউনিস্ট পার্টির একচেটিয়া ক্ষমতার জন্য হুমকি। তিনিই ২০১৬ সালে তৎকালীন ব্যবসাবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেন।

এই অভিযানের অংশ হিসেবে দুজন প্রেসিডেন্ট ও দুই উপপ্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতেও বাধ্য করা হয়েছে। শতাধিক কর্মকর্তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এখন তাঁদের সঙ্গে যোগ হলেন ধনকুবের এই নারী—ট্রুং মাই ল্যান।

মায়ের সঙ্গে প্রসাধনীর ছোট্ট দোকান দিয়ে ট্রুং জীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা করার পর জমি ও সম্পত্তি কেনা শুরু করেছিলেন, যা ডোই মোই নামে পরিচিত। ১৯৯০-এর দশকে তিনি একটি বড় হোটেল ও রেস্টুরেন্টের মালিক হন।

আমাদের বিচারব্যবস্থাও এ ধরনের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংস্কৃতি, বেনামি ঋণ, মালিকপক্ষের দোর্দণ্ড প্রতাপ ও অনিয়ম, পরিচালনগত ব্যর্থতা এবং জালিয়াতির ব্যাপারে মাঝেমধ্যে জোরালো ও কঠিন মন্তব্য করেছে। তবে শেষমেশ অভিযুক্ত পক্ষ বা শক্তিশালী মালিকপক্ষ বা বিরাট বিরাট ঋণখেলাপি এখনো নিজেদের বিচারের বাইরে রাখতে পেরেছেন। সামাজিক অভিযোগ বা মিডিয়া ট্রায়ালে তেমন কাজ হয়নি।

অন্যান্য ধনী ব্যক্তির মতোই ট্রুং জমি ও আবাসন ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল আয় করতে থাকেন। রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি ব্যবহারের সুবিধা নেন ট্রুং। পরে তাঁকে তিনটি ছোট ব্যাংককে একটি বৃহত্তর সত্তায় একীভূত করার ব্যবস্থার অনুমতি দেয় সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংক।

ভিয়েতনামের আইনে যেকোনো ব্যাংকে ব্যক্তি বা পরিবারের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, শত শত শেল কোম্পানি ও তাঁর প্রক্সি হিসেবে কাজ করা ব্যক্তির মাধ্যমে ট্রুং আসলে সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হয়ে ওঠেন। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের লোকদের ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। এরপর নিজের নিয়ন্ত্রণ করা শেল কোম্পানির নেটওয়ার্কে শত শত ঋণ অনুমোদন করার জন্যও আদেশ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

আইনজীবীদের ভাষ্যমতে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিন বছরের মধ্যে তিনি তাঁর গাড়িচালককে দিয়ে ব্যাংক থেকে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার (১০৮ ট্রিলিয়ন ভিয়েতনামি ডং) তুলে তাঁর বেজমেন্টে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ব্যাংক নোটে এই পরিমাণ অর্থের ওজন দুই টন।

ট্রুং যে ঋণ নিয়েছেন, তা কখনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ঋণ যাচাই-বাছাই না করার জন্য বড় অঙ্কের ঘুষ দিতেন তিনি। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান পরিদর্শক। বর্তমানে তিনি ৫০ লাখ ডলার ঘুষ নেওয়ার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন।

বাংলাদেশে আমরা যখন পত্রপত্রিকায় বেশ কিছু দুর্বল বাণিজ্যিক ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে আত্তীকরণের সংবাদ পাচ্ছি, তার পেছনের কারণ হিসেবে প্রায় সব বিশ্লেষকই দুর্বল হিসেবে বিবেচিত ব্যাংকগুলোয় একই ধরনের বেনামি ঋণ, মালিকপক্ষের বা এক-দুটি পরিবারের একচ্ছত্র প্রভাব, বিরাট অঙ্কের মন্দ ঋণ, মালিকদের আত্মীয়স্বজনের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি বা পদায়ন এবং ব্যাপক পরিচালনগত অনিয়মের কথা বলছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগের পেছনে সরকারের ওপর মহলেরও ‘অনেক হয়েছে, আর নয়’ গোছের নির্দেশ রয়েছে বলে জানা গেছে।

পত্রপত্রিকায় বিডিবিএল আর কৃষি ব্যাংক ছাড়াও বারবার বেসিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা মালিকপক্ষের ব্যাপক জালিয়াতি আর অনিয়মের শিরোনাম হয়েছে।

অনেক ব্যাংকেই মালিকপক্ষের নির্দেশে অনুমোদিত সময়ের বাইরে মোটা অঙ্কের ক্যাশ বা নগদ লেনদেন হয়েছে। আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে ঋণ অনুমোদিত হয়েছে। এমনকি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই বিদেশেও টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই মালিকের বা পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন কতিপয় ইসলামি ব্যাংকের বিষয়ে এখনো যদিও আত্তীকরণের কথা শোনা যায়নি, তারপরও ব্যাপক অনিয়মের তথ্য বাজারে চাউর রয়েছে।

আমাদের বিচারব্যবস্থাও এ ধরনের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংস্কৃতি, বেনামি ঋণ, মালিকপক্ষের দোর্দণ্ড প্রতাপ ও অনিয়ম, পরিচালনগত ব্যর্থতা এবং জালিয়াতির ব্যাপারে মাঝেমধ্যে জোরালো ও কঠিন মন্তব্য করেছে। তবে শেষমেশ অভিযুক্ত পক্ষ বা শক্তিশালী মালিকপক্ষ বা বিরাট বিরাট ঋণখেলাপি এখনো নিজেদের বিচারের বাইরে রাখতে পেরেছেন। সামাজিক অভিযোগ বা মিডিয়া ট্রায়ালে তেমন কাজ হয়নি।

তবে আমাদের পুরোপুরি হতাশ হওয়া উচিত হবে না। কে জানে, একদিন ভিয়েতনামের মতো আমাদের সরকার বা বিচারব্যবস্থাও হয়তো জেগে উঠবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফেরানোর মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারী, সৎ উদ্যোক্তা আর জনগণের স্বার্থ হবে উচ্চকিত।

● মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক