মতামত

বিবস্ত্র কুকি নারীরা বিলকিস বানুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন

মণিপুরে নারী নিগ্রহ ও সহিংসতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল
ছবি: এএফপি

ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ‘রেপ ভিকটিম’ হলেন বিলকিস বানু। দেশটির প্রায় সব সংবাদমাধ্যম বছরের পর বছর তাঁর দুর্ভোগ ও বিচার প্রার্থনার বিবরণ ছেপেছে।

২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় মার্চে তাঁকে যখন দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয় তখন ২১ বছর বয়সী এই নারী মা হওয়ার পথে ছিলেন। দাঙ্গায় তাঁর পরিবারের অন্তত সাতজন নিহত হওয়ার মাঝেই বিলকিসের লাঞ্ছনা ঘটে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ১১ ব্যক্তি এই অপরাধে যুক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে তাঁদের যাবজ্জীবন সাজাও হয়। কিন্তু বিজেপি সরকার তাঁদের কারাগার থেকে ছেড়ে দেয় গত বছর এই সময়ে।

এত আলোচিত একটা অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্তদের এভাবে মুক্তি দেওয়ায় ২০২২-এর ভারত প্রতিবাদে প্রত্যাশামতো সোচ্চার হতে পারেনি। একটা অন্যায় আরেকটা অন্যায়ের রাস্তা তৈরি করে রাখে। প্রশ্ন উঠেছে, তার কারণেই কি মণিপুরে কুকি নারীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অবিশ্বাস্য জুলুমের ঘটনা ঘটতে পারল? সে কারণেই কি কুকি নারীদের এখন সবাই মণিপুরের বিলকিস বানু বলছেন?

সংখ্যালঘুর বিপন্নতা

বিলকিস বানু মুসলমান ছিলেন। কুকি নারীরা খ্রিষ্টান। মুসলমানরা গুজরাটে সংখ্যালঘু। কুকিরা মণিপুরে সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরুর যেকোনো যুদ্ধ সংখ্যালঘুর নারীর গায়ে হাত না দিয়ে পূর্ণতা পায় না। ঐতিহাসিক সব সহিংসতার এটাই চূড়ান্ত সত্য। সেটা এমনকি নির্বাচনী গণতন্ত্রের জন্য গর্ববোধ করে, এমন একটা দেশেও ক্রমাগত সত্য হতে দেখে বিশ্ব বিস্মিত!

ভারত সরকার হয়তো এটা মানতে চাইবে না যে মণিপুরে এখন যুদ্ধাবস্থা চলছে। কিন্তু এও অসত্য নয়—শিগগিরই তিন মাস পূর্ণ হবে সেখানকার চলতি সহিংসতার। রাজ্যটিতে আগুনে ক্রমাগত বাড়িঘর পুড়ছে, মানুষ মরছে, যোগাযোগব্যবস্থা স্থবির। রাজনীতি, প্রশাসন ও রাষ্ট্র মানুষদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। মেইতি ও কুকিরা যে যেখানে পারছে অবাধে পরস্পরের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাচ্ছে। একে একপ্রকার যুদ্ধাবস্থা বলা যায় বৈকি।

বিলকিস বানুদের ২০০২-এর গুজরাটের সঙ্গে এর ফারাক কেবল এটুকু, সেখানে উগ্র সংখ্যাগুরুর হাতে একতরফা মার খেতে খেতে মুসলমানরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের পাশে বিশ্বের কম দেশ ও সংস্থা শক্তভাবে সোচ্চার হয়েছিল। সেখানে ধর্ষককে সাজা থেকে রেহাই দিলেও সরকারের ভোট কমেনি। সেই তুলনায় মণিপুরে খ্রিষ্টান কুকিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তৎপর। ইউরোপ-আমেরিকাও তাদের বিপন্নতার প্রতিকার চাইছে উচ্চকণ্ঠে। সেখানে অনেক বিধায়ক বিজেপি ছেড়ে চলে আসতেও বিলম্ব করেনি। অর্থাৎ মণিপুর গুজরাটের মতো নয়। তবে মণিপুরের ‘সমাজ’ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

গুজরাটে ২০২২ এসে অপরাধীরা ছাড়া পেলেও মণিপুরে রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রের সরকার এখনো সরাসরি এটা বলছে না গত ৮০ দিনের ঘটনাবলিতে মূল দায় কার? কারা কীভাবে সহিংসতার পাটাতন তৈরি করল এবং সেটাকে তুষের আগুনের মতো মাঝে মাঝে উসকে দিচ্ছে? ইতিমধ্যে যে স্থানীয় প্রতিকার ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে সেটাও বিপজ্জনক। কুকিরা তাদের নারী নিগ্রহের জন্য অভিযুক্তদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ মেইতি বন্যতার বিপরীতে কুকি বন্যতার উত্থান ঘটছে।

নারীর গণনিগ্রহ

দলবদ্ধ সহিংসতায় ধর্ষণ বরাবরই একটা অস্ত্র হিসেবে আছে বিশ্বব্যাপী। দক্ষিণ এশিয়ায়ও এর নজির বিস্তর। বাংলাদেশের নিরীহ নারীরা একাত্তরে একই অনাচারের শিকার হয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের দ্বারা।

সংবাদপত্রের পুরোনো পাঠকদের হয়তো খেয়াল আছে, মণিপুরে রাষ্ট্রীয় রক্ষীদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ২০০৪ সালের জুলাইয়ে স্থানীয় নারীরা উলঙ্গ হয়ে মিছিল করেছিলেন। অভিনব সেই বীরত্বসূচক মিছিলের খবর প্রকাশিত হয় বিশ্বজুড়ে। ইম্ফলে সেদিনের ওই প্রতিবাদে সামনের সারিতে ছিলেন মেইতি নারীরা। আসাম রাইফেলসের হাতে তাঙ্গজাম মানোরোমা নামের এক নারীর মৃত্যু ওই বিক্ষোভের জন্ম দেয়। আজ আবার মণিপুর একইভাবে বিক্ষুব্ধ। তবে এবার কুকি নারীরা মেইতি পুরুষদের হাতে গণনিগ্রহের শিকার।

দুর্ভাগ্যের দিক হলো ২০০৪ সালে যে মেইতি নারীরা ধর্ষণকে সহিংসতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রতিবাদ করছিলেন তাদেরই উত্তরসূরিরা এবার মেইতি পুরুষদের উৎসাহিত করেছেন কুকি নারীর লাঞ্ছনায়। এবারের সহিংসতার ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, মেইতি নারী-পুরুষেরা যৌথভাবে কুকিপাড়াগুলোয় হামলা করে নারীদের উলঙ্গ করে হাঁটাচ্ছে। ‘দ্য কুইন্টে’ ২২ জুলাই প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে এমন একজন নির্যাতিত কুকি নারীর বিবরণ বেরিয়েছে, যেখানে তাঁকে ধর্ষণের জন্য পুরুষদের হাতে তুলে দেওয়ার আগে পিটিয়ে অচেতন করে দিচ্ছিলেন মেইতি নারীরা।

মণিপুরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে নানাভাবে এসব ভিডিও ও ছবি ছড়াচ্ছে বিশ্বব্যাপী। অনেক অসত্য ছবি এবং বিবরণও নিয়মিত ছড়াচ্ছে মেইতি ও কুকিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে। সত্য-অসত্য মিলে এ রকম সব ঘটনায় কুকি ও মেইতি পারস্পরিক বিদ্বেষ আরও বাড়ছে। দেশটির অন্য সব ধরনের সংখ্যালঘুদের ভীতিও তাতে বাড়ছে। মহাশক্তিধর ভারত সরকার অজ্ঞাত কারণে এসব থামাতে পারেনি।

পারস্পরিক জাতিগত বন্যতার উত্থান?

মণিপুরের চলতি অবস্থার দায় অনেকখানিই স্থানীয় প্রাদেশিক সরকার ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ওপর বর্তায়। ২০০২ সালের গুজরাটের মতো ২০২৩ সালেও মণিপুরে রয়েছে বিজেপির নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকার। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে, ২১ বছর আগের মতোই বিজেপি সহিংসতার মধ্যে নারীদের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হলো। সর্বশেষ যে দুজন কুকি নারীর নিগ্রহে ভারতজুড়ে মানুষ অসন্তুষ্ট তাতে উলঙ্গ করে হাঁটানোর ১৭ দিন পর থানায় কেস আকারে এটা নথিভুক্ত হয়েছে। এতে প্রশাসনে সংখ্যাগুরুর প্রভাব কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়।

গুজরাটে ২০২২ এসে অপরাধীরা ছাড়া পেলেও মণিপুরে রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রের সরকার এখনো সরাসরি এটা বলছে না গত ৮০ দিনের ঘটনাবলিতে মূল দায় কার? কারা কীভাবে সহিংসতার পাটাতন তৈরি করল এবং সেটাকে তুষের আগুনের মতো মাঝে মাঝে উসকে দিচ্ছে? ইতিমধ্যে যে স্থানীয় প্রতিকার ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে সেটাও বিপজ্জনক। কুকিরা তাদের নারী নিগ্রহের জন্য অভিযুক্তদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ মেইতি বন্যতার বিপরীতে কুকি বন্যতার উত্থান ঘটছে।

বিলকিস বানুদের নিরাপত্তা তাহলে কে দেবে?

কুকি নারীদের নিপীড়নের ঘটনায় ব্যাপক বৈশ্বিক নিন্দার মুখে মেইতি মুখপাত্ররা এটা বলে এখন তাদের সমাজের আচরণকে ন্যায্যতা দিতে চাইছেন যে তাঁদের নারীরাও বিগত দিনগুলোতে কুকি জঙ্গিদের হাতে একইভাবে আহত, নিহত ও নির্যাতিত হয়েছেন। বলা বাহুল্য, তাদের উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণেরও সত্যতা আছে। তাদের নিরাপত্তার দায়ও সরকারের ওপরই বর্তায়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০ জুলাই লোকসভা দাঁড়িয়ে মণিপুরের ঘটনাবলিকে লজ্জাজনক বলে কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সময় সুপ্রিম কোর্টও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারকে নারী লাঞ্ছনার প্রতিকারে সক্রিয় হতে বলেছে। এসব দেখে ভারতজুড়ে বিবেকবান মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, উলঙ্গ নারীদের হাঁটানোর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগে ভারতের উচ্চ আদালত ও কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী ৮০ দিন ধরে চলমান এই সহিংসতায় কেন নীরব ছিলেন? মণিপুর নিয়ে তাঁদের সরব হতে এ রকম একটা ভিডিও প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো কেন?

এটা প্রকৃতই বিস্ময়কর, জনপ্রতিনিধিরা যে সমাজ শাসন করে, যেটা এখন আর বিদেশি শাসিত কোনো জনপদ নয়, যেখানে জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় বহু ধরনের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন আছে, সে রকম এক সমাজে কীভাবে দীর্ঘ সময় এভাবে সহিংসতা চলতে পারে এবং প্রায়ই নারীদের এ রকম নিগ্রহ ঘটতে পারে?

ভারতে বর্তমান শাসক দলের একটা বহুল আলোচিত উদ্যোগ হলো ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শুরু করা ‘বেটি বাঁচাও’ কর্মসূচি। মণিপুরের ঘটনার পর এসব কর্মসূচির রাজনৈতিক আবেদন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। মণিপুরের ঘটনার পর দেশটির নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়াও বড় অদ্ভুত দেখাচ্ছে। কয়েকটি বিক্ষোভ সমাবেশে প্ল্যাকার্ড ছিল: ‘এটা আমাদের ভারত নয়’! তাহলে এই মণিপুরের দায় কার? বিলকিস বানুদের নিরাপত্তা তাহলে কে দেবে?

  • আলতাফ পারভেজ গবেষক