১০ নভেম্বর সিডনি থেকে ফেরার পথে হংকং বিমানবন্দরে দেখা হয় বাংলাদেশের একটি বেসরকারি কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলেন মেশিন কেনার জন্য। জিজ্ঞেস করলাম, দক্ষিণ কোরিয়া কেমন দেখলেন? উত্তরে বললেন, সেখানে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। আগে দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখত। এখন ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও তাদের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আছে।
জানতে চাইলাম, দক্ষিণ কোরিয়ায় যেসব বাংলাদেশি কর্মী কাজ করেন, তাঁদের কারও সঙ্গে কথা হয়েছে কি না। একজন বললেন, অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। তাঁরা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হতাশ। তাঁরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠান। অর্থনীতিকে সচল রাখছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ৭০ হাজার প্রবাসী কর্মী আছেন। তাঁরা যদি দেখতে পান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর রাজনৈতিক দলগুলো ঝগড়া, মারামারি, হানাহানিতে ব্যস্ত—স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হওয়ার কথা। তাঁরা চান দেশে সুন্দর রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় থাকুক। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হোক।
তাঁর কথায় সিডনিপ্রবাসী বাঙালিদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় এক লাখ বাঙালি আছেন, যাঁদের বেশির ভাগের বাস সিডনিতে। সেখানেও বাঙালিদের মধ্যে নানা মত ও বিভাজন আছে। কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থক, কেউ বিএনপির সমর্থক। কেউ বাম ঘরানার। কিন্তু তাঁদের সবার অভিন্ন অনুভূতির নাম বাংলাদেশ। তাঁরা চান বাংলাদেশের জয় হোক। সিডনিতে যেসব প্রবাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। প্রশ্ন করেছেন, নির্বাচন কি হবে? সব দল কি নির্বাচনে আসবে? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। যঁারা রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন, যাঁরা ক্ষমতায় আছেন কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা বলতে পারবেন।
প্রথম আলোর রজতজয়ন্তীর স্লোগান ‘হারবে না বাংলাদেশ’-এর প্রশংসা করলেন অনেকে প্রবাসী বন্ধু। বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী বললেন, ‘দেশে থাকতে প্রতিদিন প্রথম আলো পড়তাম। অস্ট্রেলিয়ায় এসে মুদ্রিত কাগজ দেখতে না পারলেও অনলাইনে পড়ি। অন্তত দুই ঘণ্টা পরপর প্রথম আলোয় হালনাগাদ খবর জেনে নিই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রবাসীরা অনলাইনে নিয়মিত প্রথম আলো পড়েন ভালোবাসার তাগিদ থেকে।’ তাঁরা বললেন, প্রথম আলো সাধারণ মানুষের সাফল্য ও বিজয়ের গল্পগুলো যেভাবে তুলে ধরছে, তা অতুলনীয়।
আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার বিষয়টিও সামনে এল। বাংলাদেশে তিন হাজারের কাছাকাছি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছেন; যঁাদের ৯০ শতাংশ পড়াশোনার পাশাপাশি কাজও করেন।
তিন দশক ধরে আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একজন প্রবাসী আইনজীবী বললেন, বাংলাদেশ থেকে যেসব ছেলেমেয়ে এখানে পড়তে আসেন, তাঁরা প্রথমেই ভাষা সমস্যায় পড়েন। ইংরেজি ভাষাটা মোটামুটি জানা থাকলেও উচ্চারণগত সমস্যার কারণে তাঁরা বুঝতে পারেন না। এ জন্য তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফনেটিক অ্যালফাবেট বা আইপিএ পদ্ধতি অনুসরণের ওপর জোর দেন।
১১ নভেম্বর যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বাচন বানচাল করার বিরুদ্ধে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। খুবই ভালো কথা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনই হলো ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায়। কিন্তু সেই নির্বাচনটি তো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা আরও বলেছেন যে নির্বাচনে আসার জন্য কাউকে দাওয়াত দেওয়া হবে না। কথাটি তঁারা সরকার বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বললে এর একটি অর্থ আছে। আওয়ামী লীগের নেতারা এত দিন বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য নানা রকম উপদেশ দিতেন। এখন কি ভাবছেন, বিএনপি না এলেই ভালো? এ কারণেই ‘দাওয়াত’ এর প্রসঙ্গ তুলেছেন।
সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর সরকার বা প্রশাসনের দায়িত্ব নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা। তারা সেই কাজটি আইনমাফিক করতে পারলে নির্বাচন নিয়ে এত হাঙ্গামা হতো না। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্য দলকে দাওয়াত দিতে পারে না। অন্যান্য দলের মতো আওয়ামী লীগও নির্বাচনে অন্যতম দাওয়াতি। একজন দাওয়াতি অন্য কাউকে দাওয়াত না দেওয়ার কথা বললে জনমনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।
তফসিল ঘোষণা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা চলছে। একজন কমিশনার তো বলেই দিয়েছিলেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল হবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট। এখন শোনা যাচ্ছে, চলতি সপ্তাহে তফসিল হতে পারে। ইতিমধ্যে ইসলামী আন্দোলন ঘোষণা দিয়েছে, সমঝোতা ছাড়া তফসিল হলে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করা হবে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা দায়িত্ব নেওয়ার পর বলেছিলেন, তাঁরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করবেন না। এর মাধ্যমে তাঁরা ওই দুটি নির্বাচনের ত্রুটি ও দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। এরপর তাঁরা বললেন, বিএনপির মতো দল অংশ না নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি যেখানে এসে ঠেকেছে, তাতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের চেয়েও খারাপ নির্বাচন হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এত দিন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করার কথা বলতেন। এখন নির্বাচন কমিশনও স্মার্ট নির্বাচনের আওয়াজ তুলছে। কিন্তু কীভাবে তারা নির্বাচনটি করবে? স্মার্ট নির্বাচন বলতে তারা অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বুঝিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর ভোট ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে মনোনয়নপত্র অনলাইনে দাখিলে ‘অনলাইন সাবমিশন সিস্টেম’ (ওএনএসএস) এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নির্বাচন ব্যবস্থাপনাও এর মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ যুগে যুক্ত হলো। কিন্তু মানুষ যে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে, সেই নিশ্চয়তা তাঁরা দিচ্ছেন না। নির্বাচনে প্রার্থী, দল, পোলিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটার।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে পুরো দেশ মাতোয়ারা হয়ে আছে। এটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিদিন বক্তব্য হচ্ছে। এমনকি এটার গ্লোবাল একটা ডাইমেনশনও পেয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আমাদের নির্বাচনটা দেখতে আগ্রহী। বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা থেকে পর্যবেক্ষকেরাও আসবেন।’
তিনি যখন এই কথাগুলো বলছেন, তখন বাস্তবতা কী। বাস্তবতা হলো ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সভা–সমাবেশ করে নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। আরেক দলের নেতারা হয় জেলে আছেন, না হয় জেলে যাওয়া থেকে রেহাই পেতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি যখন এই কথাগুলো বলছেন, তখন দেশে অবরোধ চলছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সবকিছুই একটি নির্বাচনের জন্য।
প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আল মাসুদ হাসানুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, একতরফা নির্বাচন গণতন্ত্রকে আরও সংকটে ফেলবে। এর অর্থ রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। জনজীবনে অনিশ্চয়তা বাড়বে। এখন নির্বাচন কমিশনকেই ঠিক করতে হবে, তারা একটি বিনা দাওয়াতি নির্বাচন করবে, না সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা করবে। তারা পেছনে তাকিয়ে দেখতে পারে, আগের কোন কমিশনকে মানুষ কীভাবে মূল্যায়ন করছে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com