ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী ইসলামবিরোধী সংগঠন প্যাট্রিওটিক ইউরোপিয়ানস অ্যাগেইনস্ট দ্য ইসলামাইজেশন অব দ্য ওয়েস্টের (পেগিডা) নেতা এডভিন ভাগেনসভেলড্ গত সপ্তাহের শুরুতে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে প্রকাশ্যে পবিত্র কোরআন ছিঁড়ে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক কথাবার্তা বলে সে দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছেন। তাঁর সেই অসহিষ্ণুতা এতটাই চরমপন্থী ছিল যে তার সঙ্গে তুলনা করলে আমেরিকার ডানপন্থী রাজনীতিকদেরও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা মনে হবে। এ ঘটনার পর সপ্তাহান্তেই ড্যানিশ চরম ডানপন্থী দল স্ট্রাম কার্সের (হার্ড লাইন) নেতা রাসমুস পালুদান স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের সামনে প্রকাশ্যে পবিত্র কোরআন পুড়িয়ে দেন।
সুইডেন ও নেদারল্যান্ডসের এ দুটি ঘটনা যে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং তাদের পরস্পরের মধ্যে যে যোগসাজশ আছে, তা ভাগেনসভেলডের কথা থেকেই পরিষ্কার হয়েছে। পবিত্র কোরআন ছিঁড়ে ফেলার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘শিগগিরই কয়েকটি শহরে একই কাজ করার জন্য নিবন্ধন করা হবে।’ তিনি এটিও বলেছিলেন, ‘ইসলামের দিক থেকে যে অশ্রদ্ধা এসেছে, তার জবাব অশ্রদ্ধা দিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।’
ফলশ্রুতিতে উসকানিদাতারা যা চেয়েছিলেন, তা-ই হয়েছে। মুসলিমপ্রধান বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। যথারীতি পশ্চিমা নেতারাও মুসলমানদের মুক্তবাক–সংক্রান্ত ভাষণ দিয়েছেন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ মতের প্রতি ‘শ্রদ্ধা’ প্রদর্শন করতে বলেছেন। এখন এসব ইসলামবিদ্বেষী উসকানি, তার জবাবে মুসলমানদের ক্ষোভ প্রকাশ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতাসুলভ সান্ত্বনা বাক্যবর্ষণ অনেকটা পরিচিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নাজুক অবস্থায় থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশানা করে যেখানে এসব উসকানিমূলক ঘটনা ঘটানো হয়, সেখানকার সমাজে কি তার কোনো প্রভাব পড়ে? অন্য ধর্মের যে পবিত্র গ্রন্থে তাঁদের বিশ্বাসই নেই, সেই গ্রন্থকে বিদ্বেষ ছড়ানো প্রোপাগান্ডায় ব্যবহার করা নিয়ে কি পশ্চিমা সমাজে বসবাসরত অমুসলিমদের মাথা ঘামানো উচিত?
উত্তর হলো, হ্যাঁ, উচিত। কারণ এ ধরনের ইসলামবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা গণতন্ত্রের মুক্ত জগৎকে খাটো করে এবং শুধু মুসলমান নয়, প্রত্যেক মানুষের নিরাপত্তাকে খর্ব করে। আমার নেতৃত্বে ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং (আইএসপিইউ) নামের ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান সমাজ এবং তাদের ওপর প্রভাব ফেলা বিভিন্ন নীতি নিয়ে গবেষণা করে থাকে। একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে আমাদের গবেষকেরা আইএসপিইউ ইসলামোফোবিয়া ইনডেক্স নামের একটি মান সূচক তৈরি করেছেন।
ওই সূচকের মাধ্যমে তাঁরা মুসলিমবিদ্বেষী কার্যকলাপকে আমেরিকার কোন গোষ্ঠী কী মাত্রায় স্বীকৃতি দেয়, তা পরিমাপ করেন। পাঁচ বছর ধরে আমরা আমেরিকার ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের, বয়সের এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকা ও না থাকা মানুষকে ইসলামোফোবিয়া ইনডেক্সে ফেলেছি। আমরা গবেষণা করে বের করার চেষ্টা করেছি, ইসলামবিদ্বেষী পক্ষপাত ঠেকাতে কোনটি সহায়তা করে এবং কোন কোন নীতি অন্ধভাবে মুসলিমবিরোধিতার প্রতি জনগণের সম্মতি পয়দা করে। ওই ইনডেক্স থেকে ফল হিসেবে যে চিত্র পাওয়া যায় তা বড় জটিল; দিন শেষে সেখান থেকে যে সরল সত্যিটা বেরিয়ে আসে, তা হলো: ইসলামবিদ্বেষ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।
‘মুসলমানদের ওপর সহিংসতা নেমে আসার জন্য মুসলমানেরাই দায়ী’ অথবা ‘অন্যদের চেয়ে মুসলমানেরা কম সভ্য’—এমন ধারণা পোষণ করা মুসলমানবিদ্বেষীদের মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করাকে অনুমোদন দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের লোকেরা কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে সেই হামলা–সম্পর্কিত যে তথ্য কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করে, তা যাচাই না করার পক্ষে থাকে।
আমরা গবেষণায় দেখেছি, গৎবাঁধা মুসলিমবিরোধিতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে খুবই আশ্চর্যজনকভাবে মুসলমানদের নিশানা করে তৈরি করা রাষ্ট্রীয় নীতি বা আইনের (যেমন মসজিদের ওপর নজরদারি এবং ট্রাম্পের আমলের ‘মুসলিম ব্যান’ নীতি যার আওতায় মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল) যোগসূত্র আছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ইসলামবিদ্বেষী ধারণায় বিশ্বাসীরা শুধু মুসলমানদেরই অধিকার কেড়ে নিতে চায় না, তারা নিজেরাও নিজেদের অধিকার কর্তৃত্ববাদের হাতে সমর্পণ করে। ইসলামোফোবিয়া ইনডেক্সে ওপরের সারিতে অবস্থানরতরা স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদের কাছে মাথা নুয়ে থাকে।
‘মুসলমানদের ওপর সহিংসতা নেমে আসার জন্য মুসলমানেরাই দায়ী’ অথবা ‘অন্যদের চেয়ে মুসলমানেরা কম সভ্য’—এমন ধারণা পোষণ করা মুসলমানবিদ্বেষীদের মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করাকে অনুমোদন দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের লোকেরা কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে সেই হামলা–সম্পর্কিত যে তথ্য কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করে, তা যাচাই না করার পক্ষে থাকে। সোজা কথায় ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা মুক্তসমাজের মৌলিক ভিত্তিকেই খাটো করে থাকে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডালিয়া মোগাহেদ ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের গবেষণা পরিচালক