মতামত

তলেতলে আপস, কার সঙ্গে কার?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ৩ অক্টোবর আমিনবাজার ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় আয়োজিত ‘শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে’ বক্তব্য দেন।
ছবি : প্রথম আলো

ওপরের শিরোনামটি দেখে দেশবাসী হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন। ভাববেন, নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, সেটি কেটে গেছে। কেননা, ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ও মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য ওবায়দুল কাদের যখন কথাটি বলেছেন, তখন এটিকে গুরুত্ব দিতেই হবে।

তিনি ৩ অক্টোবর আমিনবাজার ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় আয়োজিত ‘শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ’–এ ‘তলেতলে’ আপসের কথাটি জোরেশোরে উচ্চারণ করেন এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেন।  নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অনেক দিন ধরেই মাঠে আছেন। এরপর নতুন করে প্রস্তুতির কথা কেন এল তা বোধোগম্য নয়। তাহলে কি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নেতা–কর্মীদের মনের সংশয় কাটাতে আপসের কথাটি কি সামনে নিয়ে এলেন?

তিনি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আপস হয়েছে, এ রকম কোনো ইঙ্গিত দেননি।

সমাবেশের ওবায়দুল কাদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘দুই সেলফিতেই বাজিমাত। এক সেলফি দিল্লি, আরেক সেলফি নিউইয়র্কে। শেখ হাসিনা আর পুতুল, জো বাইডেনের সেলফিতে দিল্লিতে বাজিমাত। এরপর নিউইয়র্কে বাজিমাত। কোথায় স্যাংশন, কোথায় ভিসা নীতি।’

এরপর তিনি  ‘গুপ্ত রহস্য’ উদ্ঘাটন করে বলেন, ‘আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে, আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরাও আছি। শত্রুতা কারও সঙ্গে নেই, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে ভারসাম্য করে ফেলেছেন। আর কোনো চিন্তা নেই। যথাসময়ে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন।’

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথায় মনে হতে পারে, এতদিন শেখ হাসিনা ভারসাম্য করতে পারেননি বলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় ছিল। এখন ভারসাম্য করে ফেলায় সেই সংশয় নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দাবি, ৭০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে শেখ হাসিনার প্রতি। কিন্তু সেই সমর্থন পরীক্ষা করার জন্য দিল্লি–ওয়াশিংটনের সঙ্গে আপস করলে হবে না। আপস হতে হবে নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছুক সব দলের মধ্যে। দেশের মানুষই ঠিক করবে, কার পক্ষে কত জনমর্থন  আছে। নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হতে পারে। হওয়া জরুরি।

একই সঙ্গে নভেম্বরে সেমিফাইনাল খেলা ও জানুয়ারিতে ফাইনাল খেলা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন এই নেতা। কিন্তু খেলাটি কার সঙ্গে কার হবে, সেটা বলেননি।

আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি করে ফেলতে চাইছে। বিএনপি বলেছে, তারা এই সরকারের অধীন নির্বাচনে যাবে না। সে ক্ষেত্রে নাটকীয় কোনো ঘটনা না ঘটলে ধরে নিতে পারি, আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী দলগুলোর মধ্যেই ‘খেলা’ হবে এবং বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো মাঠের বাইরেই থাকবে। প্রকৃত খেলা হতে হলে সমানে সমান প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে হয়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন নিয়ে যে আপসের কথা বলেছেন, সেটি যে কোনো স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জাজনক। নির্বাচনটা হবে বাংলাদেশে। নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি বাংলাদেশের জনগণ। আর আপসটা হচ্ছে দিল্লি ও ওয়াশিংটনে। আপসটা কীভাবে হলো, কে করলেন, সেই ইংগিত দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে ভারসাম্য করে ফেলেছেন।’ কীভাবে ভারসাম্য করলেন? ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, দিল্লি ও নিউইয়র্কে দুই সেলফিতেই বাজিমাত হয়েছে। সেটাই যদি হবে, তাহলে মার্কিন কর্মকর্তারা সদলবলে ঢাকায় এসে বারবার ভিসা নীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে যাচ্ছেন কেন?

গত ২৭ সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের যে বৈঠক হয়, তাতেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়, সে বিষয়ে আবারও জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

হোয়াইট হাউসের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগবিষয়ক সমন্বয়কারী জন কারবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জ্যাক সুলিভানের সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন নিয়েও তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

দিল্লি ও নিউইয়র্কে সেলফি তোলার পরই কিন্তু এই বৈঠক হয়। দুই সেলফিতেই যদি বাজিমাত হয়ে যাবে, তাহলে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে হলো কেন? আন্তর্জাতিক কূটনীতি সম্পর্কে যাঁদের ‘অ আ’ জ্ঞান আছে, তাঁরাও জানেন, সেলফি তুলে দুই দেশের সম্পর্কের ররফ গলানো যায় না।

তারপরও যদি ওবায়দুল কাদের নিশ্চিত হন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে যে মতভেদ, সেটা সেলফি তোলার পর মিটে গেছে, তাহলে তিনি ভিসা নীতির বিরুদ্ধে ফের সরব হলেন কেন? কেন বললেন, ভিসা নীতি পরোয়া করি না।

বাস্তবতা হলো মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণা ও প্রয়োগের পর ক্ষমতাসীন মহলে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কখনো তারা বলেন, ভিসা নীতি সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়ক হবে। কখনো বলেন, একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্ত নৌবহর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি, এবারেও নির্বাচনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ওবায়দুল কাদের যে সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে বলে নেতা–কর্মীদের আশ্বস্ত করলেন, সেখানেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম বললেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ভিসা নীতি পরোয়া করে না। কারও চোখরাঙানিতে ভয় নেই।’

সাধারণ নাগরিকেরা কোনটা বিশ্বাস করবে? দলের নেতাকর্মীরাই–বা কোনটা বিশ্বাস করবে?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দাবি, ৭০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে শেখ হাসিনার প্রতি। কিন্তু সেই সমর্থন পরীক্ষা করার জন্য দিল্লি–ওয়াশিংটনের সঙ্গে আপস করলে হবে না। আপস হতে হবে নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছুক সব দলের মধ্যে। দেশের মানুষই ঠিক করবে, কার পক্ষে কত জনমর্থন  আছে। নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হতে পারে। হওয়া জরুরি।

কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বাইরের কোনো দেশের সঙ্গে তলে তলে আপস হতে পারে না।

  • সোহরাব হাসান : কবি ও সাংবাদিক
    sohrab.hassan@prothomalo.com