গত নভেম্বর মাসে বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সংঘাত নিরসনে ১০ দফা ঘোষণা করেন। তিনি যেসব দাবি তুলেছেন, এর মূল বিষয় হলো, ২০১৪ সালের পর থেকে রাশিয়া ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের যতটা ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে, তার সবটা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
সর্বশেষ জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৮৫ শতাংশ ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির আপসহীন এই অবস্থান সমর্থন করেছেন। কিন্তু রাশিয়ার অবস্থান আগের মতোই অনমনীয় রয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন এ অবস্থানে অনড় যে যেকোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হতে হবে ‘মাঠের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে’। রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের ২০ শতাংশ ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে। মস্কোর চাওয়া হচ্ছে কিয়েভ যেন ওই ভূখণ্ডকে রাশিয়ার বলে স্বীকার করে নেয়।
দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনা অনেক দূরবর্তী বিষয়। রাশিয়া নতুন করে ইউক্রেনের ওপর যে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে, তাতে দেশটির জেনারেলদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে দুপক্ষের মধ্যে একেবারেই কোনো আলাপ-আলোচনা হচ্ছে না।
তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় পর্দার অন্তরালে দুই পক্ষের মাঝে বেশ কিছু বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। রোমান আব্রামোভিচদের মতো অলিগার্কেরা এ ধরনের আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। আবুধাবি ও আঙ্কারা নতুন এই স্নায়ুযুদ্ধে হেলসিঙ্কি ও ভিয়েনার ভূমিকা পালন করছে। সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে শহর দুটিতে খুব সহজেই রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও গোয়েন্দারা সাক্ষাৎ করতে পারছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন বন্দী বিনিময়সংক্রান্ত আলোচনা বেশ সফলতা পেয়েছে। তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় গত সেপ্টেম্বর মাসে মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে ৩০০ জন যুদ্ধবন্দী বিনিময় হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাগাড়ম্বর থাকলেও বন্দী বিনিময়ের প্রশ্নে কোনো পক্ষেই আদর্শগত বিরোধ দেখা দেয়নি। প্রথম দফায় ইউক্রেনের ২১৫ জন সৈন্যকে মুক্তি দিয়েছিল মস্কো। আর কিয়েভ ৫৫ জন রাশিয়ান বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিল। এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত বন্দী বিনিময় চলছে।
পারমাণবিক নিরাপত্তার বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনাটি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশ ঘিরে একটি ‘সুরক্ষিত অঞ্চল’ গড়ে তোলার জন্য দুই পক্ষের সংলাপে মধ্যস্থতা করছেন।
যুদ্ধের শুরুতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দখল করে নেয় রাশিয়া; সেপ্টেম্বর মাসে ভুয়া গণভোটের মাধ্যমে ওই অঞ্চল নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় মস্কো। রাশিয়ার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইউক্রেন। কেন্দ্রটিতে ইউক্রেনীয় কর্মীরা কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
এরপরই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দুই পক্ষের যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নভেম্বর মাসে গ্রোসি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চারপাশে বোমা ও গোলাবর্ষণ ‘উন্মাদের মতো’ আচরণ। রাশিয়া দাবি করে, ইউক্রেন বেপরোয়াভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে হামলা করছে। অন্যদিকে, ইউক্রেন দাবি করে, রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বাহিনীর ওপর গুলি চালাতে কেন্দ্রটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
ডিসেম্বরের শুরুর দিকে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে—দুই পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছতে পেরেছে। কিন্তু ‘সুরক্ষিত অঞ্চল’ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। ইউক্রেনের চাওয়া হলো, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে রাশিয়ার সেনা ও লোকবল পুরোপুরি প্রত্যাহার। ইউক্রেনের এ অবস্থানকে সমর্থন করে জি-৭ গত অক্টোবর মাসে একটি বিবৃতি দিয়েছিল।
কিন্তু রাশিয়ার ভয় হলো, নতুন করে কোনো এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হলে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হবে এবং ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রত্যাঘাত করার সুযোগ পেয়ে যাবে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে গ্রোসি সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, এ বছরের শেষ নাগাদ একটি মীমাংসা হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
পর্দার অন্তরালে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে দ্বিতীয় যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা হলো সার বাণিজ্য। বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে সারসংকট বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছে। রাশিয়া সার তৈরির মূল উপকরণ অ্যামোনিয়ার প্রধান রপ্তানিকারক দেশ।
যুদ্ধের কারণে মধ্য রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের ওদেসা বন্দর পর্যন্ত সোভিয়েত আমলে তৈরি পাইপলাইনের মাধ্যমে অ্যামোনিয়া পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাইপলাইনটি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পরই বন্ধ হয়ে যায়। জুলাই মাসে তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে ওদেসা বন্দর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি করতে দিতে রাজি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ওদেসা বন্দর দিয়ে অ্যামোনিয়া রপ্তানি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে পাইপলাইনটি চালু করতে অসম্মতি জানায় ইউক্রেন।
জাতিসংঘ দুই পক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা করে। তাদের চেষ্টায় রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিরা গত ১৭ নভেম্বর আবুধাবিতে বৈঠক করেন। সরাসরি আলোচনার টেবিলে এ ধরনের চুক্তি হওয়া বেশ জটিল। এমন হতে পারে, রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি সেই অ্যামোনিয়া কিনে নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করবে। পাইপলাইন আবার খুলে দিতে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বন্দী বিনিময়ের শর্ত দেওয়া হয়।
১৫ ডিসেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সার জাহাজিকরণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করে। এ পদক্ষেপ ইউক্রেন, পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ায় প্রতিবাদ বিক্ষোভের জন্ম দেয়। কয়েক দফা আলোচনার পরও অ্যামোনিয়া পাইপলাইনটি এখন পর্যন্ত খোলেনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন বন্দী বিনিময়সংক্রান্ত আলোচনা বেশ সফলতা পেয়েছে। তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় গত সেপ্টেম্বর মাসে মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে ৩০০ জন যুদ্ধবন্দী বিনিময় হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাগাড়ম্বর থাকলেও বন্দী বিনিময়ের প্রশ্নে কোনো পক্ষেই আদর্শগত বিরোধ দেখা দেয়নি। প্রথম দফায় ইউক্রেনের ২১৫ জন সৈন্যকে মুক্তি দিয়েছিল মস্কো। আর কিয়েভ ৫৫ জন রাশিয়ান বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিল। এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত বন্দী বিনিময় চলছে।
পর্দার অন্তরালের এসব অনাষ্ঠুনিক আলোচনার কোনটা থেকেই আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না যে, খুব শিগগির দুই পক্ষে শান্তি আলোচনা শুরু হবে। ইউক্রেনকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন পুতিন। ফলে সত্যিকারের শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা খুব সীমিত। কিন্তু দুই পক্ষই আনুষ্ঠানিক উপায়ে কিছু বিষয়ে মীমাংসার জন্য আলোচনায় বসছে। সাধারণ মানুষের ওপর যুদ্ধের যে ভয়ানক প্রভাব, তা কমিয়ে রাখছে পর্দার অন্তরালের এসব আলোচনা।
ডেভিড লুইস যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত