বছর দেড়েক আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড লক্ষণীয়ভাবে কমে আসে, বিরোধী দলের পক্ষে প্রায় বিনা বাধায় সমাবেশ করা সম্ভব হয় এবং দেশের আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে সরকার এই স্যাংশন ও এটি প্রদানকারী দেশ আমেরিকার বিভিন্ন সমালোচনা শুরু করে।
এর পর থেকে স্যাংশন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে। আরও স্যাংশন দেওয়া হচ্ছে কি না, দিলে কী ধরনের স্যাংশন দেওয়া হচ্ছে, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা হতে থাকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এসব জল্পনার কিছু উত্তর মিলেছে ২৪ মে গভীর রাতে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এদিন বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে দেশটির অব্যাহত নজরদারির কথা স্পষ্ট করে দেন।
এই নতুন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম, হস্তক্ষেপ ও বাধা দান করা হলে এর সঙ্গে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি ও তার পরিবারকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এটি অনুসারে ভুয়া ভোট প্রদান, ভোটার ও নির্বাচনী এজেন্টদের বাধা দান, নির্বাচনী সমাবেশে হামলা, গায়েবি মামলা প্রদান, নির্যাতন-নিপীড়ন, মতপ্রকাশে বাধা দান ইত্যাদি কাজ নির্বাচনে অনিয়ম ও হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এসব কাজে জড়িত থাকলে সরকারের সব পর্যায়ের ব্যক্তিরা (যেমন: মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী) এবং বিরোধী দলেরও যে কেউ এই ভিসা নীতির তোপে পড়তে পারেন।
নতুন এই ভিসা নীতি তাই স্যাংশনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক। কারণ, এটি নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয়, বরং এটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগযোগ্য সর্বজনীন নীতি। এই নীতির আলোকে কারও আমেরিকান ভিসার আবেদন প্রত্যাখাত হলে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মিত্র যেসব দেশ বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় গন্তব্যস্থল (অবকাশ, ব্যবসা বা সন্তানদের শিক্ষার জন্য) সেখানে ভিসাপ্রাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে এই ভিসা নীতির কথা সরকারকে ৩ মে তারিখে জানানো হয়েছে। এরপর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যে অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া (আমেরিকা থেকে আমদানি বন্ধের ঘোষণা, আমেরিকাসহ কিছু রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের পুলিশি প্রহরা ও পতাকা ব্যবহার প্রত্যাহার) ব্যক্ত করা হয়েছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে এই ভিসা নীতিকে স্যাংশনের চেয়ে কম ক্ষতিকর কিছু বলে বিবেচনা করছে না সরকার।
নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা আসার পর সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য বলছেন, তাঁরা এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। কারণ, তাঁরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবেন। তাঁদের মতে, নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের সময় সহিংসতা চালানোর কারণে ভিসা নীতির জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা বরং বিএনপির।
যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে মতামত প্রচারে বিরত রাখাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার মতো একটি কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এটিও মূলত ক্ষমতাসীনদের বিবেচনায় রাখার মতো একটি বিষয়।
মন্ত্রীদের বক্তব্য এক অর্থে সঠিক। সত্যি সত্যি অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার সদিচ্ছা থাকলে আমেরিকান ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের উদ্বেগের কিছু নেই। কিন্তু এ জন্য সরকারকে প্রথমে বুঝতে হবে যে এ ধরনের নির্বাচন মানে কী। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য কী করতে হবে, কী ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, তার নজির ও ব্যাখা এ দেশের অতীত নির্বাচন, মানবাধিকারসম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও দেশীয় দলিল এবং সর্বশেষ নির্বাচনসম্পর্কিত নানা পর্যবেক্ষণ (যেমন বিবিসি, টিআইবি ও সুশাসনের জন্য নাগরিক), পরিসংখ্যান (যেমন ভোট দানের হার, জয়-পরাজয়ের ব্যবধানের অঙ্ক) ও সংবাদে (গায়েবি মামলা, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর হামলাসংক্রান্ত) রয়েছে। সরকার বা বিরোধী দল কী বলল, শুধু তার বিচারে নয়, উপরোক্ত বিষয়গুলোও নির্বাচনে কী কী অনিয়ম করেছে বা কারা করেছেন, তা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে মতামত প্রচারে বিরত রাখাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার মতো একটি কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এটিও মূলত ক্ষমতাসীনদের বিবেচনায় রাখার মতো একটি বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র তার ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে তার নিজস্ব একটি আইন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট অনুসারে। এই আইন অনুসারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসারে এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধে ভিসা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষমতা পররাষ্ট্র দপ্তরের রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি তাই বাংলাদেশের অনেকের কাছে অমর্যাদাকর বলে বিবেচিত হতে পারে। এই নীতি আরোপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, এ ধরনের দাবিও কেউ চাইলে করতে পারেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যেসব কাজের কারণে ভিসা প্রত্যাখান করা হবে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যেসব কাজ সম্পাদন করা বা সেগুলো সমর্থন করা আমাদের নিজস্ব আইন ও সংবিধানেও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেমন বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায়ও ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সমাবেশে সহিংসভাবে বাধা দান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব অপরাধের বিচার আমরা করতে পারলে অন্য রাষ্ট্রের কথা বলার সুযোগ থাকত না।
ভিসা নীতি ঘোষণার পর সাংবাদিক সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের জনগণকে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে এবং এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত আছে। তিনি এ–ও বলেছেন যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দানকারী ব্যক্তিকে জবাবদিহির আওতায় আনার সামর্থ্য যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের এই বক্তব্য এ দেশের ভোটাধিকারহীন মানুষের মনে নতুন আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারে। আবার, আমরা কেউ তাঁর এই বক্তব্যের সমালোচনাও করতে পারি। বলতে পারি যে পৃথিবীর কিছু দেশে বরং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু আমাদের এ–ও মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে অন্য দেশের পররাষ্ট্রনীতির স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি থাকে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে উল্লেখিত দেশের নির্বাচনের মতো হস্তক্ষেপ করেছে এই অভিযোগ শোনা যায়নি, তার ভিসা নীতিতেও এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত নেই। বরং যেসব কারণে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে নৈতিকভাবে আপত্তি করার সুযোগ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির সমালোচনা করে আরও বহু কিছু বলা যেতে পারে। যেমন আমরা কেউ বলতে পারি যে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে কাছে টানার জন্য বা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে আরও সুবিধা পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এসব করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব বলে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশকে বাংলাদেশে স্যাংশন বা ভিসা নীতির পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারব না। বিরত রাখতে পারব না দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের চাপ থেকেও।
আমরা এসব পারব ভালো কাজ করে। অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেই কেবল আমরা উল্লেখিত আশঙ্কা দূর করতে পারব। বাংলাদেশের জন্য মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করতে পারব।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক