এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে হলে আকর্ষণীয় সুবিধা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই সূত্র ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছিল।
এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে হলে আকর্ষণীয় সুবিধা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই সূত্র ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে কেন জাদুঘর করা জরুরি

এ শতকের শূন্যের দশকে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সে সময় একটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করো’। দুই দশক পর বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার দিকে তাকালে দেখব যে পাবলিক, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১৬০ ছাড়িয়েছে। মানে, জেলার সংখ্যার হিসাবে গড় করলে প্রতি জেলার ভাগে পড়বে প্রায় আড়াইটি বিশ্ববিদ্যালয়।

একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা শনৈঃশনৈঃ করে বাড়লেও জ্ঞান উৎপাদন ও গবেষণায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে কি? প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে?

আমাদের সমাজে উচ্চশিক্ষার চাহিদা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। কুয়ালালামপুরের মোনাশ ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহর গবেষণা জানাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় যেতেন মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই সংখ্যাকে দুই অঙ্ক, মানে দশের ঘরে নিয়ে যেতে সময় লেগেছে পাক্কা ৩৮ বছর। ২০১০ থেকে ২০২০—এ ১০ বছরে উচ্চশিক্ষায় যাওয়া শিক্ষার্থীর অনুপাত ১০ থেকে বেড়ে ২০-এ গিয়ে পৌঁছেছে।

এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের পেছনে মূলত ব্যবসার চিন্তাটা প্রধানভাবে ভূমিকা পালন করেছে। এ থেকে আমাদের এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতির রূপটা বা পুঁজি সঞ্চয়নের প্রক্রিয়াটা বোঝা যায়। এখানে জরুরি প্রশ্নটা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি কারা পেয়েছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? আবার সরকারি খাতে নতুন নতুন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে, সেখানে উপাচার্য ও অন্যান্য প্রশাসনিক পদে কারা নিয়োগ পেয়েছেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়বেন, তাঁরা কী শিখবেন, তাঁদের কর্মসংস্থান কী হবে—এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে। সরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় মানে অবকাঠামো খাতে শত শত কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ। আর বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় মানে টিউশন ফি। ফলে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বেপরোয়া আয়ের একটা অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়।

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশরা যখন কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল, এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সিভিল সার্ভেন্ট তৈরি করা। টমাস বেবিংটন মেকলে যেটাকে বলেছিলেন গায়ের রং কালো হলেও চিন্তাচেতনা ও কথাবার্তায় হতে হবে ইংরেজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিল সেই একই চিন্তা। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর এবং বাংলাদেশ পর্বের ৫৩ বছরেও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সেই ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি।

এখন পর্যন্ত একটা বিশ্ববিদ্যালয়কেও আমরা সৃজনশীল জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। এর মানে হচ্ছে, চাকরির জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির বাইরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কথা চিন্তাও করেননি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক দায়িত্বে তাঁদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবধান বিস্তর। এ ধরনের অতিরিক্ত সুবিধা একজন সাধারণ অধ্যাপক থেকে একজন উপাচার্যকে কার্যত খুব শক্তিশালী করে তোলে। তার মধ্যে একটা স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি ও দম্ভ তৈরি করে।

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে সৃজনমুখী জ্ঞান ও গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে অন্তত একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে মডেল হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুটা যেখানে সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উচ্চশিক্ষার সংস্কার যাত্রা সূচনা হওয়া উচিৎ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতীকের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এখান থেকে শুরু হওয়া বিদ্রোহ গত ৭৮ বছরে এ ভূখণ্ডের ইতিহাসের গতিপথ বার বার করে পাল্টে দিয়েছে।

এ ভয় ও শঙ্কা থেকেই ক্ষমতায় যারা গেছে, তারাই বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার সেটাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় বিকশিত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে গেটের দারোয়ান, সবাই হয়ে উঠেছিল বিগত সরকারের একেকটা ক্ষমতা ও নিপীড়নের কেন্দ্র।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্রলীগকে উচ্ছেদ করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ও নিপীড়নের সেই কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। আইয়ুব আমলের এনএসএফ, এরশাদ আমলের জাতীয় ছাত্রসমাজের পর ছাত্রলীগকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে।

এই বিতাড়নের তাৎপর্য ছিল অনন্য ও বহুমাত্রিক। হাসিনা সরকারের অন্যতম ভয় উৎপাদনের কেন্দ্র ছাত্রলীগের উচ্ছেদ হওয়ার মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের ভয় ভেঙে যায়, যেটা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পথ তৈরি করে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিন আইনে চলে। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর—এই চার বিশ্ববিদ্যালয় চলে ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী। ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বাধীনতা কেড়ে নেন। এর প্রতিবাদে এক দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষকেরা আন্দোলন করেছিলেন।

এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭৩-এর অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একাডেমিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যে আইনে চলে, সেখানে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যূনতম স্বার্থ রক্ষা করা যায়, এমন ট্রেড ইউনিয়ন করারও অধিকার নেই সেখানে। এক দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কেন ভিন্ন ভিন্ন আইনে চলবে, সেই প্রশ্নও এখন সামনে আনা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুসারে চললেও ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালের আইনও চালু আছে। এই আইনবলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ক্ষমতা একচ্ছত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তখন ঢাকা মফস্‌সল শহর। এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে হলে আকর্ষণীয় সুবিধা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই সূত্র ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছিল।

যা-ই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস, পরীক্ষা চালু করতে হলে সবার আগে দরকার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে যে বিস্তর ফাটল তৈরি হয়েছে, সেই দেয়াল সবার আগে ভেঙে ফেলা। এর জন্য সবার আগে দরকার উপাচার্যসহ, প্রক্টর, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, শিক্ষা উপদেষ্টার মতো পদগুলোতে সেই সব শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া, যাঁরা ছাত্রদের কাছাকাছি থাকেন।

ছাত্রদের যেকোনো সংকটে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ছাত্রদের ভাষা বুঝতে পারেন। এসব পদে দলমতের বিবেচনার চেয়েও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেসব নিয়োগ হয়েছে, তাতে এর প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক দায়িত্বে তাঁদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবধান বিস্তর। এ ধরনের অতিরিক্ত সুবিধা একজন সাধারণ অধ্যাপক থেকে একজন উপাচার্যকে কার্যত খুব শক্তিশালী করে তোলে। তার মধ্যে একটা স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি ও দম্ভ তৈরি করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, উপাচার্যের বাড়িকে বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর কিংবা বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন।

তিনি বলেছেন, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারসহ ওপরের স্তরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সুবিধা অনেক বেশি। এটা অনেক বড় বৈষম্যের জায়গা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যে বাড়িতে থাকেন, সেটা তো আসলে বৈষম্য ও ঔপনিবেশিক শাসনামলের একটা নিদর্শন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার যে লোভ তৈরি হয়, তার প্রথম ধাপ এই বাড়ি।

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিক করার সুযোগ এনে দিয়েছে। ঔপনিবেশিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আইন ও পরম্পরা জিইয়ে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিক করা কতটা সম্ভব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনকে জাদুঘরে রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার যাত্রা শুরু হতেই পারে।

মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী