মতামত

লিটন দাস বনাম সাংবাদিকের দ্বন্দ্বের গোড়াটা আরও গভীরে

লিটন দাস
লিটন দাস

একটা বিশাল স্টেডিয়াম। গ্যালারিভর্তি মানুষ। সবাই উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। ঘটনা কী? সামনের স্টেজে একটা মানুষের সামনে বাঘকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুধার্ত, হিংস্র বাঘের সামনে খালি হাতের একটা মানুষ। পালানোর জায়গা নেই। একটু পরে মানুষটাকে বাঘটা ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। এ কারণেই এত উত্তেজনা।

সেই উত্তেজনায় ঘি ঢালে বাজির দর। কেউ বলে আজ বাঘটাকেই ও মেরে ফেলবে। কেউ বলে, এই যে বালুঘড়িটা উল্টালাম। এর আগেই লোকটার মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে বাঘ মামা।

দৃশ্যটা বাস্তব ছিল রোমান সাম্রাজ্যে। কুখ্যাত কলোসিয়ামে মানুষ বনাম বাঘ কিংবা মানুষ বনাম মানুষের মরণলড়াই দেখে লোকে উত্তেজিত হতো। সেই উত্তেজনা জিইয়ে রাখার জন্য একের পর এক খেলা চলত, চলত, চলতই।

দুই হাজার বছর পর কলোসিয়াম আর নেই ঠিকই, কিন্তু অবিরত উত্তেজনায় বুঁদ হয়ে থাকার নেশা কাটেনি মানুষের। পেটে ভাতের অভাব, শাসকের লাথি—সব ভুলিয়ে দেওয়ার দুরন্ত আফিম।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ফরাসি দার্শনিক গি দেবখ তাঁর সমাজকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘সোসাইটি অব স্পেক্টাকল’ নামে। ছোট্ট এক বইয়ে তিনি দেখান, কীভাবে দুই হাজার বছর আগের মতোই আমাদের সামনে একটার পর একটা দৃশ্য ছুড়ে দেওয়া হয়, আর আমরা তাতে বুঁদ হয়ে থাকি। আরেকজন সমাজবিজ্ঞানী হারবার্ট মারকুইসে আধুনিক মানুষকে আখ্যা দেন ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান হিসেবে। তখন টেলিভিশন মাত্র শুরুর দিকের ব্যাপার।

লিটন দাস বনাম সাংবাদিকের লড়াইয়ে এসব আলাপ কেন? না, ক্রিকেট যে জনতার আফিম, এ দিয়ে যে ভুলিয়ে রাখা হয়, সেই আলাপে যাচ্ছি না, বরং তারকা খেলোয়াড় লিটন দাসের সাংবাদিকদের অপমানের গোড়াটা যে আরও গভীরে, সেই বোঝাপড়ারই এক চেষ্টা।

মারকুইজের টেলিভিশনের যুগ থেকে এখন আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। এখন আমরা ইউটিউবের ভিডিও পার হয়ে সংক্ষিপ্ত রিলের যুগে চলে আসছি। মিনিটখানেকের বেশি ধৈর্য আমরা ধরে রাখতে পারি না।

একটা সরকারি অফিসের কথা কল্পনা করা যাক। বছর তিরিশেক আগেও, একটা টেবিলে একজনের সামনে থাকত শুধু ফাইলপত্র আর অবসর সময়ের জন্য আড্ডা না হয় সংবাদপত্র। স্কুলে থাকতে শিক্ষকদের কাছে শুনতাম দুর্লভ বইগুলো তিনি হাতে লিখে অনুলিপি করে ফেলতেন। এরপর এল টিভি, এখন মুঠোফোন।

বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ—যাযাবরের এই কথাকে একটু উল্টিয়ে বলা যায়, প্রযুক্তি আমাদের ঋদ্ধ করেছে, বিপুল তথ্যভান্ডার আর বিনোদনের অফুরন্ত উৎস খুলে দিয়ে; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা।

আমাদের স্কুপের নেশায় ছোটা, প্রতিদিন ক্লিকবেইট করা, কার আগে কে হুলুস্থুল করে সংবাদ দিয়ে দুটো লাইক বেশি পাবে, এ প্রতিযোগিতায় থাকাদের যাত্রাটা ওই ঝুলে থাকা কেরানির মতোই। সারাক্ষণ আদিম কলোসিয়ামের দর্শকদের মতো আধুনিক ভিউয়ারদের উত্তেজিত রাখার এক মহাযজ্ঞের তাঁরা যে অংশ! দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ যজ্ঞের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় দর্শকদেরই, রোমান আমল হোক কিংবা আধুনিক দুনিয়ায়।

পুঁজিবাদী উৎপাদনের মূল আলাপ হচ্ছে অফুরন্ত প্রবৃদ্ধি। উৎপাদন করতেই থাক, করতেই থাক। কিন্তু এ এক অসম্ভব আকাঙ্ক্ষা। এর মূল্য চোকাতে হয় পরিবেশের ধ্বংস করে, মানুষের সমাজে অসাম্য তৈরি করে।

আমাদের অফুরন্ত উৎসের মূল্য আমাদের চোকাতে হচ্ছে মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আমরা ফাস্ট ফুড যেমন গিলি, খাই না, তেমনি আমরাও অজস্র কনটেন্ট দেখি, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করি না। টলস্টয়ের—একজন মানুষের কতটুকু জমি দরকার—গল্পের পাথুমের মতো আমরা প্রাণপণ কেবল ছুটছি। আমরা জানি না, আমাদের লক্ষ্য কী।

কারণ, আমাদের ছুটতে হবে। নাগরিক জীবনের ব্যবস্থাটাই সেভাবে করা। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে যে বিজ্ঞাপন আর নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়, মানব মনের গহিন বিশ্লেষণে মানুষকে ভোক্তা বানানো হয়। উৎপাদনের থামাথামি নেই।

কলোসিয়ামের উত্তেজনা পার হয়ে, পণ্যর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের যুগের পর আমাদের এখনকার সময়ের সবচেয়ে মূল্যবান বাণিজ্য পণ্য হয়ে উঠেছে আমাদের মনোযোগ। ভোক্তাদের সসীম সময় কে কত বেশি কিনতে পারে, তার জন্য গড়ে উঠেছে ট্রিলিয়ন ডলারের অ্যাটেনশন ইকোনমি।

আর এ অ্যাটেনশন ইকোনমির দুই যোদ্ধা হচ্ছেন আমাদের তারকা খেলোয়াড় আর সাংবাদিকেরা। এটা ঠিক যে কলোসিয়ামের বন্দীদের মতো তারকা খেলোয়াড়দের বাঘের সামনে পড়ে জীবন দিতে হয় না, কিন্তু একজন তারকা হতে হলে তাঁকে ত্যাগ করতে হয় সবকিছু।

আদতে মনে হতে পারে, তারকার জীবন না জানি কত আকর্ষণীয়। তাঁদের তো বলাই হয়, তারকা—আকাশে তাঁদের বাস। কিন্তু, তারকা হওয়ার পথটা বড় পিচ্ছিল। লাখ লাখ খেলোয়াড়ের মধ্যে কয়জন তারকা হন? অন্যদের কী অবস্থা হয়? আর তারকা হওয়া তো কেবল দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না, সুযোগ, ভাগ্য এসবও লাগে। এরপরেই কি শেষ? এই মোহের জীবন কাটাতে বিসর্জন দিতে হয় সব ধরনের স্বাধীনতা, আকাঙ্ক্ষা। কত বড় বড় খেলোয়াড় যে জটিল মনোরোগের শিকার হয়েছেন, তার হিসাব নেই, কতজন তো আত্মহত্যাও করেছেন।

তাই বলে কোনোভাবেই তাঁদের বাজে আচরণ কিংবা ধরাকে সরা জ্ঞান করাকে সমর্থন করা যায় না। লিটনও ক্ষমা চেয়েছেন।

কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে সর্বকালের সেরা স্নুকার খেলোয়াড় রনি ওসুলিভানের কথা। ভদ্রলোকের বাবা খুনের দায়ে যাবজ্জীবন খেটেছেন, ট্যাক্স ফাঁকির দায়ে জেল খেটেছেন মা। রনির একাধিক আত্মজীবনীতে জানা যায়, এরপরও তিনি নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। মাঝেমধ্যেই ভেঙে পড়েছেন, অসহ্য যন্ত্রণায় চিকিৎসা নিয়েছেন, কিন্তু আবার ফিরে এসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।

এত গেল তার দৃঢ়তার কথা। আরেকটা কারণে তার অবতারণা করলাম। রনির বাবা যেদিন জেল থেকে প্যারোলে ছাড়া পান, তিনি সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ করেছিলেন, আমার পরিবারকে দয়া করে প্রাইভেসি দিন। অনেক দুর্নাম থাকলেও ব্রিটিশ মিডিয়া তা রক্ষা করেছিল।

ভাবুন তো, আমাদের দেশে কি তা সম্ভব হতো কখনো?

কারণ ওই যে বললাম, একে তো আমাদের সামনে অসীম পরিমাণ কনটেন্ট হাজির করার প্রতিযোগিতা, আর দ্বিতীয়ত আমাদের দৈন্য। আমাদের সাংবাদিকতার অবস্থা খারাপ, এ খাতে কাজ করা কর্মীদের বেতন লজ্জাজনক, ফলে টিকে থাকার জন্য তাঁদের বুনো লড়াই চালাতে হয়। লিটনের একটা ফুটেজ, সাকিবের একটা এক্সক্লুসিভ, তামিমের একটা স্কুপের জন্য জীবনটাই বাজি রাখা যায়, মানসম্মান তো দূর কি বাত!

ওই যে কলকাতার এক গল্প ছিল, এক লোক অফিসের সময় কোনোমতে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছিলেন বলে এক পথচারী জিজ্ঞাসা করেন, ও দাদা, পরের বাসটাতে গেলে হয় না? এত তাড়া কেন? জীবনের থেকে কি চাকরি বেশি দামি?

হ্যাঁ দাদা, উত্তর দেন ঝুলন্ত কেরানি। জীবন তো পিতৃদত্ত, মাগনা পেয়েছি, এই বাজারে চাকরি গেলে তা কি আর পাব?

আমাদের স্কুপের নেশায় ছোটা, প্রতিদিন ক্লিকবেইট করা, কার আগে কে হুলুস্থুল করে সংবাদ দিয়ে দুটো লাইক বেশি পাবে, এ প্রতিযোগিতায় থাকাদের যাত্রাটা ওই ঝুলে থাকা কেরানির মতোই। সারাক্ষণ আদিম কলোসিয়ামের দর্শকদের মতো আধুনিক ভিউয়ারদের উত্তেজিত রাখার এক মহাযজ্ঞের তাঁরা যে অংশ!

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ যজ্ঞের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় দর্শকদেরই, রোমান আমল হোক কিংবা আধুনিক দুনিয়ায়। সোসাইটি অব স্পেক্টাকলে অসীম কনটেন্টের স্রোতে পিষ্ট হয়ে ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যানরা চিন্তাশূন্য, মনোযোগ খোয়ানো পুতুলে পরিণত হন।

কিন্তু এ থেকে উতরানো খুবই দুরূহ ব্যাপার। শাসকগোষ্ঠীর বিপুল ক্ষমতার বিরুদ্ধে একক মানুষ এই লড়াই করতে গেলে স্রেফ উড়ে যাবে। কিন্তু, লিটন বনাম সাংবাদিকের এই আপাত লড়াইয়ে, ফেসবুকে লিটনের পক্ষে হাজার হাজার হা হা কিংবা সাংবাদিকের প্রতি সহানুভূতির দ্বন্দ্বে চাপা পড়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা যে হয় দর্শকের, তা বোঝা জরুরি।

ক্ষতিটা সংবাদমাধ্যমেরও হয়। কনটেন্ট সরবরাহের নিরন্তর চাপে মান নিয়ে ভাবার সময় কই তার? যাদের সেই ক্ষমতা আছে, তাদের নত হতে হয় ট্রেন্ডের চাপে, তা না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। অস্তিত্বের সংকটেরই টানাটানি পড়বে। তা করতে গিয়ে নিজের মান খুইয়ে ফেলে, সম্মানও।

কারণ, ইংরেজিতে বলে শো মাস্ট গো অন। এই করতে গিয়ে শো-এর বিভিন্ন কুশীলবের মধ্যে দ্বন্দ্ব হবে। অর্থনীতির চাকা ঘোরানো পোশাকশ্রমিকের সঙ্গে ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটের শত্রুতা লাগিয়ে রাখা হবে, বাসের চালকের সহকারীর সঙ্গে যাত্রীর।

কার্ল মার্ক্স নামক এক জার্মানের কথা ধার করে বলতে হয়, এ বিভেদগুলো এত সাদাকালো না, এগুলো দ্বান্দ্বিক। আমাদের জীবনের গাড়িতে শুধু ছোটার নেশা বন্ধ করে, মাঝেমধ্যে ব্রেক কষে ভাবতে পারাটা খুব জরুরি।

কলোসিয়ামের উত্তেজনায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়াটা মানুষের জীবন হতে পারে না। সাদা আর কালোর বাইরে ধূসর বোঝাটাই আমাদের মুক্তি দেবে।

  • সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক