‘গরিবের জন্য কোনো ডিজাইন নেই, সমাধান নেই; তার জন্য আছে উচ্ছেদ, হামলা, রাইফেল ভর্তি বারুদ আর ভয়।
অন্যদিকে, প্রভুর চেয়ে বিত্তবান, ক্ষমতাধর বড়লোকদের সঙ্গেই সব আলাপ, আলোচনা, কম্প্রোমাইজ আর সুউচ্চ এক্সপ্রেসওয়ে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দুই লাইনের এমন বক্তব্য তরুণ কবি ও সংগীতশিল্পী তাহমীদ চৌধুরীর। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে এর চেয়ে স্পষ্ট, সরাসরি ও যৌক্তিক বক্তব্য আর কী হতে পারে।
আগস্টের শেষের দিকে আনসারদের সচিবালয় অবরোধের পর প্যাডেলচালিত রিকশাচালকেরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছিলেন। তাঁদের প্রধান দাবি ছিল, প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল বন্ধ করা। আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রশ্নটি জিইয়ে রেখেছিল।
এ নিয়ে আগেও পক্ষে–বিপক্ষে রিকশাচালকেরা আন্দোলন করেছেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকার একপর্যায়ে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বন্ধ করতে চাইলেও পারেনি।
এখন আওয়ামী সরকারের পতনের পর যে বিশৃঙ্খল বা নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়, সে সময় ব্যাটারি রিকশার ‘দৌরাত্ম্য’ বেড়ে যায়। যার জেরে শাহবাগ এলাকায় প্যাডেল রিকশাচালকেরা অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছিলেন। সেখানে দুই ধরনের রিকশাচালকেরা মুখোমুখি অবস্থানও নিয়েছিলেন।
আর আমরা নাগরিক সমাজ তাদের সেই বিরোধ নিয়ে ‘মজা’ নিয়েছি। কেউ কেউ ‘রিকশা লীগ’ বলে তকমা দেয় তাঁদের। কিন্তু সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। ফলে ব্যাটারি রিকশার চলাচল বন্ধে আদালতের একটি নির্দেশনার পর গত বৃহস্পতিবার আন্দোলনে নামেন ব্যাটারি রিকশার চালকেরা। যার ফলে দুই দিন ধরে চলল সড়ক অবরোধ, রেলপথ অবরোধ এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ।
জুলাই অভ্যুত্থানে রিকশাচালকদের সক্রিয় ভূমিকা আলাদাভাবে লেখা থাকবে। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আলোচনা ও উদ্যোগ দৃশ্যমান। কিন্তু সেখানে খেটে খাওয়া এসব মানুষের অবস্থান কোথায়, তাঁদের কণ্ঠস্বরই বা কোথায়? পুরোনো কাঠামো ভেঙে নয়া ব্যবস্থা গড়ে তোলার যে সম্ভাবনা বিরাজমান, সেখানে কেন এখনো পুরোনো পন্থায় অধিকার আদায়ের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয় রিকশাচালকদের। কেনই বা পুরোনো পন্থায় সেই আন্দোলনও মোকাবিলা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে?
ব্যাটারি রিকশা বেড়ে গেছে বলে শহরের যানজট বেড়ে গেছে, এমন বদ্ধমূল ধারণাও আমরা দেখি নাগরিকদের মধ্যে। অথচ শহরের যানজটের মূল কারণ প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি, সেটা কেন গুরুত্ব পায় না? যানজট কমাতে রিকশা কমানোর কথা বলা হয়। কিন্তু বছরে কয়টা নতুন প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় নামানো যাবে সেই সংখ্যা কেন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় না?
ব্যাটারি রিকশার প্রশ্ন আওয়ামী সরকার যেভাবে টেনে নিয়ে গেছে, এখনো কেন সেই একইভাবে বিষয়টিকে দেখবে বর্তমান সরকারও। আগস্টে যখন প্যাডেল রিকশার চালকেরা আন্দোলনে নামেন, তখনই কেন এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো না স্থায়ী একটি সমাধানে লক্ষ্যে?
ব্যাটারি রিকশা থাকবে কি থাকবে না বা চলবে কি চলবে না—এখনো কেন হ্যাঁ/না সমাধানই খুঁজতে হচ্ছে আমাদের? কেন নাগরিক সমাজকে এর পক্ষে–বিপক্ষে যুক্তিতর্ক হাজির করতে হচ্ছে?
কয়েক বছর ধরে ব্যাটারি রিকশার ঝুঁকিগুলো নিরসনে কী কী করা যায়, কীভাবে এই রিকশা আরও যাত্রীবান্ধব ও সড়কবান্ধব করা যায়, তার বহু তত্ত্বগত ও প্রযুক্তিগত আলাপ বিশেষজ্ঞরা করেছেন। পত্রপত্রিকায়ও সেগুলো প্রকাশ পেয়েছে।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী সরকারের পদস্থ ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ একবার সিএনজিচালিত অটোরিকশা, একবার প্যাডেল রিকশা, আরেকবার ব্যাটারি রিকশা—এই তিন পক্ষ থেকে বছরের পর বছর লাখ লাখ টাকা ঘুষ ও ঘুষ নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা না–করা নিয়ে সমস্যা জিইয়ে রেখেছেন।
ফলে বিগত সরকার কখনো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাত্তা দেননি। কিন্তু এখন কেন দেওয়া হচ্ছে না? কেন প্রযুক্তির বিস্ময়কর উল্লম্ফনের যুগে এখনো পায়ে টানা রিকশা থাকবে?
যদি ব্যাটারি রিকশা বন্ধই করতে হয়, তা কেন আগের আওয়ামী সরকারের অনুসারেই করতে হবে? ব্যাটারি রিকশার বিভিন্ন পার্টস আমদানি হয়, শত শত দোকানে সেগুলো বিক্রি হয়, সেই আমদানিকারকদের কেন ধরা হয় না? ব্যাটারি রিকশার একেকজন গ্যারেজমালিক মহাজনদের শতাধিক রিকশা, মাসে লাখ লাখ টাকা আয় তাঁদের, সেই মহাজনদের কেন ধরা হয় না? তাঁরা কি রাষ্ট্রকে এ বাবদ কোনো কর দেন? বিদ্যুৎ খরচের বিষয়টি নিয়েও তো প্রশ্ন থাকে। সেসব গ্যারেজে কেন অভিযান চালানো হয় না? কেন রাস্তায় রিকশাচালকদের ওপর জুলুম চালানো হয়, যাঁদের অনেকে কিনা ঋণ নিয়ে রিকশা কিনে থাকেন?
প্যাডেল রিকশার নিচে একটি মোটর লাগিয়ে দিয়ে যেভাবে তীব্র গতিতে এ রিকশা চালানো হয় তা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু শুধু দুর্ঘটনার দোহাই দিয়ে এ রিকশা বন্ধের দাবির যৌক্তিকতা কতটুকু? অথচ বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী ব্যাটারি রিকশার দুর্ঘটনার হার সামান্যই। সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেলে, এরপর রয়েছে ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান, বাস/মিনিবাস।
ব্যাটারি রিকশা বেড়ে গেছে বলে শহরের যানজট বেড়ে গেছে, এমন বদ্ধমূল ধারণাও আমরা দেখি নাগরিকদের মধ্যে। অথচ শহরের যানজটের মূল কারণ প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি, সেটা কেন গুরুত্ব পায় না? যানজট কমাতে রিকশা কমানোর কথা বলা হয়। কিন্তু বছরে কয়টা নতুন প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় নামানো যাবে সেই সংখ্যা কেন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় না?
গত সপ্তাহে রাজধানীতে পিআইবি অডিটরিয়ামে ন্যায্য নগর ইশতেহার নামে দুই দিনব্যাপী কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ন্যায্য নগরজীবনের অধিকার নামে একটি সেশনে পুরান ঢাকার একজন পঞ্চায়েত এম আবু হুরায়রা তাঁর আলোচনায় সিঙ্গাপুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথায় বলেন, দেশটিতে চাইলেই কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে পারেন না। তার জন্য আগে গাড়ির নম্বর সংগ্রহ করতে হয়। আর গাড়ির নম্বরও থাকে নির্দিষ্টসংখ্যক। গাড়ির নম্বর সংগ্রহের জন্যও নির্দিষ্ট ফি ও বিধিমালা আছে।
এখন ঢাকায় বছরে কত ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় নামবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। কয়টা বাস নামবে, কয়টি মোটরসাইকেল নামবে, তার কোনো কিছুই বেঁধে দেওয়া নেই। ফলে হাঁটার গতির চেয়েও ঢাকায় গাড়ির গতি এখন কম। বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবেও আখ্যা পেয়েছে রাজধানী ঢাকা। শুধু রিকশা বন্ধ করলে কি অচল ঢাকাকে সচল করা সম্ভব?
শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করেছে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ। তাদের দেওয়া সাতটি দাবির মধ্যে রয়েছে নীতিমালা অনুযায়ী ইজিবাইক, রিকশাসহ ব্যাটারিচালিত যানবাহনের নিবন্ধন, চালকদের লাইসেন্স ও রুট পারমিট দেওয়া, কারিগরি ত্রুটি সংশোধন করে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের আধুনিকায়ন করা।
এক সপ্তাহের মধ্যে দাবি না মানলে তারা সারা দেশে সংহতি সমাবেশের ডাক দিয়েছে। রিকশাচালকদের এসব দাবি যৌক্তিকতা রাখে। সেইসঙ্গে এটিও স্পষ্ট যে রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক চলাচল ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, তা বাস্তবায়ন এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের জন্য সরকারি একটি কমিটি বা কর্তৃপক্ষও থাকা দরকার, সেটি হতে পারে সিটি করপোরেশনের অধীনে।
এখন রিকশাচালকদের এ আন্দোলনের পেছনে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির হাত থাকতে পারে, এমন ধারণা অনেকের। কিন্তু যেকোনো আন্দোলনে রাজনৈতিক পক্ষ সুযোগ নেবে, সেটিই স্বাভাবিক। তা ছাড়া অবৈধ অর্থে বিপুল শক্তিশালী আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে যেকোনো আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণ খুঁজবে, সেটি আরও বেশি স্বাভাবিক।
কিন্তু শুধু ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে’ গুরুত্ব দিলে সংকটকে জিইয়ে রাখাই হবে, তা নয় কি? এখন সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা কি সমস্যার সমাধান করবেন এবং করলে তা কীভাবে?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com