রাশিয়ার জনমতের ওপর ভিত্তি করে চালানো জরিপে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর পুতিনের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে।
রাশিয়ার জনমতের ওপর ভিত্তি করে চালানো জরিপে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর পুতিনের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে।

পুতিন রাশিয়ায় এখনো কেন এতটা জনপ্রিয়

ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো বলেছিল, রাশিয়ার নেতা হিসেবে তাঁর দিন শেষ। আবার ইউক্রেনীয়রা যখন রাশিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সে সময় অনেক বিশ্লেষক দাবি করেছিলেন, পশ্চিমাদের আরোপিত অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞার ফলে শিগগিরই রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়বে এবং পুতিন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন, পশ্চিমারা রাশিয়ার অলিগার্কিদের সম্পদ ও প্রমোদতরি বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করেছে। এর ফলে শিগগিরই তারা পুতিনের মাথার ওপর থেকে তাদের ছাতা সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট আর ইউক্রেনে নিজ দেশের সেনাদের ব্যাপক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। এসব ভবিষ্যদ্বাণীর কোনোটাই এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। অদূর ভবিষ্যতে ঘটবে, সে রকম কোনো অর্থপূর্ণ লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

প্রকৃত বাস্তবতা বরং উল্টো। রাশিয়ার জনমতের ওপর ভিত্তি করে চালানো জরিপে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর পুতিনের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। অবশ্য পুতিনের প্রতি সার্বিক জনসমর্থন যতটা, তাঁর শুরু করা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন অতটা নেই। এরপরও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনকে সমর্থন দিয়েছে।

রাশিয়ার অর্থনীতি ধসিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও দেশটির অর্থনীতি বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। রাশিয়ার তেল কিনতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এবং আগের চেয়ে কম পরিমাণ গ্যাস নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করেছে। তাতে রাশিয়ার কোষাগার ভরে উঠতে সহায়তা করেছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এখন এটাও বলছেন যে জনমত জরিপের এই ফলাফল সত্ত্বেও রাশিয়ার জনগণের মধ্যে পুতিনের প্রতি গোপন ক্ষোভ রয়েছে। ভয়ের কারণে তাঁরা সেটা প্রকাশ করতে পারছেন না। আরেকটি যুক্তিও দেখানো হচ্ছে, রাশিয়ার জনগণ ক্রেমলিনের প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত। ফলে তাঁরা নিরপেক্ষভাবে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। রাশিয়ার গণমাধ্যমে পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বিকল্প কোনো ভাবনার প্রতিফলন নেই।

পুতিন বলে আসছিলেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে পদানত করে রাখতে চায়। পুতিন রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষক—তাঁর এ দাবি প্রমাণের পথ সহজ করে দিয়েছে পশ্চিম। রাশিয়ায় এখন পুতিনের অনিবার্য বিকল্প কেউ নেই। কেবল পুতিনের স্বাস্থ্যই তাঁর শাসন অবসানের ক্ষেত্রে বড় হুমকি। কিন্তু পুতিন অসুস্থ, এ দাবির ভিত্তি খুব সামান্য। এসব কারণে যৌক্তিকভাবেই আমরা বলতে পারি, পুতিনের শাসন রাশিয়ায় থাকছেই।

রাশিয়ার গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে ক্রেমলিনের প্রতি অনুগত, এ ব্যাপারে কারও কোনো প্রশ্ন নেই। আবার রাশিয়ার মাটিতে প্রকাশ্যে কেউ যুদ্ধবিরোধী কথা বললে তাঁকে চরম নিগ্রহের শিকার হতে হবে, সেটাও সত্যি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে পুতিনকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন, এমন মানুষের সংখ্যা কমে গেছে রাশিয়ায়। রাশিয়ার অনেক মানুষ এখন খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা পুতিনের শাসনের প্রতি অনুগত থাকতে চান। ভয়ের বাইরেও এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, রাশিয়ার অনেক অলিগার্ক ও রাজনৈতিক নেতা পৃষ্ঠপোষকতামূলক একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ। এই ব্যবস্থার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। পুতিন ছাড়া তাঁরা তাঁদের সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদার অনেকটাই খোয়াবেন।

রাশিয়ার সমাজের ওপরের স্তরের মানুষেরা পুতিনকে তাঁর জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডার জন্য ব্যাপকভাবে সমর্থন করেন। রাশিয়ার অনেক জাতীয়তাবাদী মনে করেন যে পুতিন রাশিয়াকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। ১৯৯০-এর দশকের মহাবিপর্যয় এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কারণে তাঁদের এ ধারণা অনেকটাই সত্য। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন রাশিয়ার মর্যাদার ওপর বিশাল এক ধাক্কা। প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিনের আমলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটা এখনো দুঃসহ স্মৃতি হিসেবে ধরা দেয় রাশিয়ার অনেক মানুষের কাছে।

বরিস ইয়েলেৎসিনের আমলে রাশিয়া পশ্চিমা উদারনৈতিক শিবিরে যুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু অনেকের কাছে এখনো মনে হয়, সেই প্রচেষ্টা অর্থনৈতিক যন্ত্রণা আর বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। এ ঘটনাকে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়াকে দ্বিতীয় স্তরের শক্তিতে পরিণত করেছিল। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদারীকরণ মোটাদাগে কোনো সুবিধাই দিতে পারেনি। এখনকার বয়স্ক রুশদের মনে এখন সেই স্মৃতি জাগরুক যে তাঁরা উদারীকরণের ধাক্কায় প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন। দুই দশক পর আবার তেমনটা ঘটুক, তা তাঁরা কোনোভাবেই চান না।

‘নিয়তিবাদী রাগ’

সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ১৯৯৮ সালে রাশিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়। সে সময়ে আমি মস্কোর নিকটবর্তী পডোলস্ক শহরে বেশ কিছুদিন ছিলাম। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছিল। আমদানির সক্ষমতা না থাকায় অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস আর পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কায় জনমনে নিয়তিবাদী ক্ষোভের জন্ম হওয়াটা স্বাভাবিক। ফলে মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন ঘটেছিল। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক যেমনটা ধারণা করেছিলেন, তার চেয়েও দ্রুত রাশিয়ার অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হয়েছিল।

অনেক রুশ আজকের দিনেও মনে করেন, গণতন্ত্র ও পশ্চিমা উদারীকরণের চেয়ে আগের সোভিয়েত আমল ভালো ছিল

১৯৯৮ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইয়েলেৎসিনের উত্তরসূরি হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতার পথ মসৃণ করে দিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল পুতিনের। ইয়েলেৎসিনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে পুতিন তাঁর নীতির খুব বেশি পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন, এমনটা আশা আমি সে সময় করিনি। প্রথম দিকে পুতিনের নীতি ইয়েলেৎসিনের মতোই ছিল।

এরপর ২০১৫ সালে আমি আবার রাশিয়া গিয়েছি। সে সময় রাশিয়ার স্পষ্ট পরিবর্তন আমার চোখে ধরা পড়ে। সড়কে ব্যাপক শৃঙ্খলা আর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা আমি শুধু দেখিনি, রাশিয়ার রাজধানী শহরে আমি মানুষের মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছাপও দেখেছি। ঠিক এক বছর আগে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজেদের অংশ করে নিয়েছে। বেশির ভাগ রুশ পুতিনের সেই অভিযানকে সমর্থন দিয়েছেন। পুতিন ঘৃণিত অলিগার্কিদের কবল থেকে শুধু রাশিয়াকে মুক্ত করেননি, তাঁদের পথে নিয়ে আসতেও সক্ষম হন। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেছেন কিংবা টেনে ধরতে চেষ্টা করছেন—সেই বিশ্বাস জনমনে গেড়েও দিতে পেরেছেন পুতিন।

বিশৃঙ্খলার পরের শৃঙ্খলা

বিশৃঙ্খলার পর পুতিন রাশিয়ায় শক্ত হাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। ইয়েলেৎসিনের আমলের অসংখ্য গণতান্ত্রিক উপাদান হাওয়া করে দেওয়ার পরও রুশরা পুতিনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পশ্চিমা ধাঁচের উদারীকরণের প্রবক্তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার খুব কমই বাস্তবায়িত হতে দেখেছেন রাশিয়ার মানুষেরা। তথ্য–প্রমাণ বলছে, অনেক রুশ আজকের দিনেও মনে করেন, গণতন্ত্র ও পশ্চিমা উদারীকরণের চেয়ে আগের সোভিয়েত আমল ভালো ছিল। সোভিয়েত পতনের পর যাঁদের জন্ম, তাঁরাও এ মনোভাব পোষণ করেন। সে কারণেই পুতিনের আমলের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশৃঙ্খল শাসন রাশিয়ায় ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

নিঃসন্দেহে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অনেক মানুষের জীবনযাপনে ধাক্কা দিয়েছে। পশ্চিমাদের আরোপ করা অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার প্রতি তাদের ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ পুতিনের বয়ানকেই শক্তিশালী করেছে। পুতিন বলে আসছিলেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে পদানত করে রাখতে চায়। পুতিন রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষক—তাঁর এ দাবি প্রমাণের পথ সহজ করে দিয়েছে পশ্চিম। রাশিয়ায় এখন পুতিনের অনিবার্য বিকল্প কেউ নেই। কেবল পুতিনের স্বাস্থ্যই তাঁর শাসন অবসানের ক্ষেত্রে বড় হুমকি। কিন্তু পুতিন অসুস্থ, এ দাবির ভিত্তি খুব সামান্য। এসব কারণে যৌক্তিকভাবেই আমরা বলতে পারি, পুতিনের শাসন রাশিয়ায় থাকছেই।

আলেক্সান্ডার হিল সামরিক ইতিহাস বিষয়ে অধ্যাপক, ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে