কিছুদিন আগে বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা নিয়ে ছোট একটি দুঃখকথা লিখেছিলাম। তাতে মূল বিষয় ছিল লাগেজ পেতে দেরি এবং অহেতুক বিমান দেরিতে ছাড়া নিয়ে। কিছুদিন ধরে লাগেজের বিষয়টি খানিকটা অগ্রগতি দেখা গেছে। আমার দুই মেয়ে গত দুই মাসে বিমানবন্দর দিয়ে আগমন করেছে। তারা তাদের লাগেজ পেয়ে গেছে খুবই তাড়াতাড়ি। লেখালেখির কারণে এমনটি ঘটেছে, তা নিশ্চয় নয়। শীতের দিন, বৃষ্টি নেই, গরমও নেই টারমাকে, এ জন্যই হয়তো এ উন্নতি। দেখতে হবে, গরম ও বৃষ্টি শুরু হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়।
তবে লাগেজ পেলেই তো হলো না, বের হয়ে গাড়িতেও তো উঠতে হবে। বেরোনোর ব্যবস্থা একটিমাত্র লাইনে। সবুজ লাইন দিয়ে যাঁরা বেরোচ্ছেন, তাঁদেরও এ লাইনে এগিয়ে লাগেজ ঢোকাতে হবে স্ক্যানিং মেশিনে। বিশেষ করে যখন কয়েকটি ফ্লাইট কাছাকাছি সময়ে নামে, তখন এ কাজে বিলম্ব হয়ে যায় মাত্রাতিরিক্ত।
এ কাজ করা হয় সম্ভবত কাস্টম ডিউটি, যাতে ফাঁকি দিতে না পারে কেউ সে লক্ষ্যে। পৃথিবীর অন্যান্য এয়ারপোর্টে এটি করা হয় দৈবচয়ন ভিত্তিতে, কিন্তু শাহজালালে এটা রুটিনে পরিণত হয়েছে, আর ফলে এখানেও আবার এক দীর্ঘ লাইনের বিড়ম্বনা।
সবচেয়ে অরাজক পরিস্থিতি আসে এরপর। যাত্রী তোলার জন্য গাড়ি জায়গামতো আসতে কতক্ষণ লাগবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। পোরটিকোর নিচে গাড়ি আসার যে পথ, সেখানে অসংখ্য মানুষ অপেক্ষমাণ। তারপর পোরটিকোর অনেকখানি জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ভাড়ার গাড়ি যারা সুনির্দিষ্ট কারও জন্য অপেক্ষা করছে না। ফলে গাড়ি ভেতরে আসার লাইন এগোয় শম্বুকগতিতে। যাত্রী নিয়ে বের হওয়ার যে পথ, সেটাও সম্পূর্ণ ব্লক করে দাঁড়ানো শত শত মানুষ। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গাড়ি বেরোনোর পথ করতে হিমশিম খাচ্ছেন নিরাপত্তাকর্মীরা।
এ তো গেল আগমনকারীদের যন্ত্রণা। প্রকট সমস্যা রয়ে গেছে বহির্গমনকারী যাত্রীদের জন্যও। এয়ারপোর্ট রোডে কাজ চলছে বছরের পর বছর। আর এই রাস্তা থেকে টার্মিনালে যাওয়ার যে পথ, সেটায় প্রচণ্ড ভিড় থাকে প্রায় সার্বক্ষণিক। তারপর বাঁয়ে মোড় নিয়ে র্যাম্পে ওঠার পথ। এখানে বিভিন্ন লেনে ভাগ করা হয়েছে রাস্তাকে। যে লেন র্যাম্পে ওঠার, সেটাতে নিরাপত্তাচৌকি আছে। কখনো থামিয়ে খোঁজ নেওয়া হয় যাত্রী ছাড়া আরও কেউ আছেন কি না গাড়িতে, আর এটা যখনই করা হয়, তখনই লেগে যায় গাড়ির দীর্ঘ লাইন। কখনো আবার কিছুই জিজ্ঞেস করা হয় না, সোজা র্যাম্পে উঠে যায় গাড়ি। র্যাম্পে উঠে ডানে মোড় নিয়ে গেটের কাছে যেতে আবার গাড়ি ও মানুষের জটলা।
টার্মিনালে ঢোকার গেট মোট ছয়টা, কিন্তু এর সব কটি চালু আছে—কখনো এমনটি দেখিনি। এমনকি কখনো কখনো দেখা গেছে স্রেফ দুটো গেট চালু এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটিতে দীর্ঘ লাইন। সব কটি গেট কেন চালু রাখা যায় না, খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, এটা করতে যে লোকবল দরকার, কর্তৃপক্ষের তা নেই। জনবল বাড়াতে প্রস্তাব চালাচালি হচ্ছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। এ কাজে জনপ্রশাসন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি লাগে, আর এ বিষয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো তাড়া নেই সেখানে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা বিষয়টি দেখছেন, এ নিয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ধারণাও খুবই সীমিত।
শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি নিয়োগ দিয়ে লোক দাঁড় করিয়ে দিলেই তো চলবে না। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সচিব বা অতিরিক্ত সচিব নিয়োগে যতটা তৎপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় লোকবল বিষয়ে তাদের ততটাই অনীহা। লোকবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের বিষয়টি আগেভাগে সেরে রাখলে বর্তমান টার্মিনালের বিদ্যমান ছয়টি প্রবেশপথে তারা ইতিমধ্যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারত। বহির্গমনকারী যাত্রীদের ভোগান্তিও কম হতো তাতে।
গেটে ঢুকতে যাত্রীরা তো লাইন দিচ্ছেনই, কিন্তু এর উল্টো পাশে সমান বা ততোধিক ভিড় দাঁড়িয়ে থেকে জটলা পাকানো মানুষের। এক-দুজনকে বিদায় জানাতে মাইক্রোবাস ভর্তি করে আরও চার-ছয়জন এসেছেন এবং গাড়ি থেকে যাত্রী নামার পরও তাঁরা চলে না গিয়ে অপেক্ষা করে ভিড় বাড়াচ্ছেন। এখানে জটলা পাকাতে না দিয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা যদি তাঁদের দ্রুত প্রস্থানের ব্যবস্থা নেন, তাহলে খানিকটা সহনীয় হতে পারে দৃশ্যপট।
শাহজালাল বিমানবন্দরের যেকোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা উঠলেই আমরা আশাবাদী হয়ে উঠি যে বিপুল ব্যয়ে নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলেই এসবের সমাধান হয়ে যাবে। বস্তুত এতে বিমানবন্দরের যাত্রী হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা হয়ে যাবে প্রায় আড়াই গুণ। আগামী অক্টোবরে তৃতীয় টার্মিনাল অন্তত আংশিক চালু হওয়ার কথা। প্রচুর আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকবে সেখানে, কিন্তু যন্ত্রপাতির পেছনে তো মানুষ লাগবে, আর সে মানুষের যথাযথ প্রশিক্ষণ লাগবে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে লোকবল লাগবে তার নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের বিষয়ে অগ্রগতি কতটা?
শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি নিয়োগ দিয়ে লোক দাঁড় করিয়ে দিলেই তো চলবে না। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সচিব বা অতিরিক্ত সচিব নিয়োগে যতটা তৎপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় লোকবল বিষয়ে তাদের ততটাই অনীহা। লোকবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের বিষয়টি আগেভাগে সেরে রাখলে বর্তমান টার্মিনালের বিদ্যমান ছয়টি প্রবেশপথে তারা ইতিমধ্যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারত। বহির্গমনকারী যাত্রীদের ভোগান্তিও কম হতো তাতে।
সবশেষে আসা যাক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস প্রসঙ্গে। ঢাকা ও টরন্টোর মধ্যে বিমানের নতুন রুট চালু হয়েছে সম্প্রতি। বাংলাদেশি প্রবাসীদের অধিকাংশের মধ্যে বিমানের প্রতি একধরনের আকর্ষণ আছে। ভাড়াও খানিকটা সাশ্রয়ী। কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি ছাড়াও নিকটস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলোয় বসবাসরত প্রবাসীরা এই ফ্লাইট ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারেন।
আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত দুজন সম্প্রতি সপরিবার বিমানে ঢাকা এসেছেন। দুজনের কেউই খুশি নন বিমানের ইন-ফ্লাইট সার্ভিস নিয়ে। তাঁরা আবার এই ফ্লাইট ব্যবহার করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
একসময় বিমানের খাবার নিয়ে সুনাম ছিল খুব। এখন খুবই সাধারণ মানের খাবার দেওয়া হয়, এ অভিযোগ অনেকের। আর খাবার দেওয়া হয়েছে বিমান উড্ডয়নের প্রায় দুই ঘণ্টা পর। কাতার বা এমিরেটসের খাবার নিয়ে এমন অভিযোগ নেই।
কাতার, আমিরাত, তুরস্ক বা ইন্দোনেশিয়া—সবই মুসলিম দেশ। এসব দেশের এয়ারলাইনগুলোয় যাত্রীদের পানীয় পরিবেশন করা হয়, বাংলাদেশ বিমানে তা করা হয় না। একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে নানা দেশের নানা ধরনের যাত্রী থাকেন। দীর্ঘ যাত্রায় পানে আগ্রহী যাত্রীরা অনেক ক্ষেত্রেই তখন বিকল্প চিন্তা করেন।
একটি দেশের বিমানবন্দর এবং বিমান সংস্থা সে দেশের একরকম মুখচ্ছবি হিসেবে কাজ করে। কোনো একজন বিদেশি অতিথি যখন বাংলাদেশে হাজির হন, তা তিনি পর্যটক, তৈরি পোশাক ক্রেতা বা বিদেশি বিনিয়োগকারী যা-ই হন না কেন, বিমানবন্দরেই তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা হয় দেশটি সম্পর্কে।
সেটা যদি ইতিবাচক হয়, তার ছাপ থাকে পরবর্তী পদক্ষেপসমূহে। বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বা বাংলাদেশ বিমানের বিকল্প রয়েছে অতিথিদের সামনে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার কাজটি শুরু করতে হবে বিমানবন্দর ও বিমান থেকেই।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব