নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বিএনপি ঢাকার বাইরে নয়টি সমাবেশ করেছে। কোনো গোলমাল হয়নি। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ নিয়ে ‘মহানাটক’ চলছে। এক নাটকের চিত্রনাট্য লিখছে দুই পক্ষ—সরকার ও বিরোধী দল।
বিএনপি অনেক দিন আগেই ডিএমপির কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিল। সে সময় ডিএমপির পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা জোর গলায় বলতে লাগলেন, বিএনপি ঢাকায় সমাবেশ করতে পারবে না। তারা চাইলে তুরাগে ইজতেমা মাঠ কিংবা পূর্বাচলে সমাবেশ করতে পারে। এর আগে অবশ্য বিএনপির এক নেতা এই বলে এলান জারি করেছিলেন যে ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ আওয়ামী লীগ সরকারের কথায় চলবে না। দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। পরে বিএনপির নেতারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটি ছিল কথার কথা।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
গত মাসের শেষ দিকে ডিএমপি থেকে বলা হয়, বিএনপিকে নয়াপল্টনে নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৬ শর্তে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলো। যদিও আওয়ামী লীগ কত দফা শর্তে এত দিন সেখানে সমাবেশ করেছে, তা ডিএমপি জানায়নি। আমরা ধরে নিতে পারি, সব সমাবেশের জন্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু শর্ত দিয়ে থাকে শান্তি ও জনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। তাই বলে ২৬ দফা শর্ত!
নয়াপল্টনে জনসভা করার ক্ষেত্রে ডিএমপির আপত্তির কারণ সড়কে যানজট। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। নিত্য যানজটের এ শহরে মাঠ কিংবা সড়ক—যে স্থানেই সমাবেশ হোক না কেন, যানজট হবেই। এ অবস্থায় ধনীরা গাড়ি বের করেন না। গরিবদের জীবিকার জন্য বের হতেই হয়।
আওয়ামী লীগের নেতাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে দিলে সেটাই হবে দেশের সবচেয়ে বড় সংকট বা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। এই সংকট থেকে দেশকে বাঁচানো বা সরকার রক্ষার একমাত্র উপায় হলো নয়াপল্টনের সামনের জনসভা ঠেকানো।
অতীতে ঢাকা শহরে জনসভা করার অনেকগুলো মাঠ ছিল। কিন্তু পূর্বাপর সরকারের অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়নের কারণে প্রায় সব মাঠই দখল হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে এখন জনসভা করার কোনো মাঠ নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করা পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর, সেটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। মাঠ আর উদ্যানের মধ্যে ফারাকটাও আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে চান না।
সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমরা ঢাকা শহরকে জনসভামুক্ত রাখতে পারতাম। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত তো শুধু বিএনপির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সব দলের জন্য প্রযোজ্য। সব দল মিলে ঠিক করুক, তারা ঢাকায় জনজীবন বিপন্ন করে সমাবেশ করবে না। আর ঘন ঘন জনসভা করার প্রয়োজনও হতো না যদি রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে সব দলের কথা প্রচার করা হতো। এসব প্রচারমাধ্যমে যে প্রতিদিন বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত করা হয়, জনসভা বা সংবাদ সম্মেলন করেই তাদের জবাব দিতে হয়। অনেকে বেসরকারি প্রচারমাধ্যমের কথা বলবেন। ব্যতিক্রম দু-চারটি বাদে সেসবও চলে সরকারের অঙ্গুলি হেলনে। দেশে এখন অঙ্গুলি হেলনের গণতন্ত্র চলছে।
বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে (যদিও এখন পর্যন্ত তার স্থান ঠিক হয়নি) আওয়ামী লীগের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা অহরহ নানা কথা বলে যাচ্ছেন। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, প্রবাসী আয় হ্রাস পাচ্ছে, ওএমএসের ট্রাকের সামনে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের দীর্ঘ সারি, বিদ্যুতের অভাবে শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আওয়ামী লীগের নেতাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে দিলে সেটাই হবে দেশের সবচেয়ে বড় সংকট বা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। এই সংকট থেকে দেশকে বাঁচানো বা সরকার রক্ষার একমাত্র উপায় হলো নয়াপল্টনের সামনের জনসভা ঠেকানো।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিএনপির নেতারা সংঘাত এড়াতে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। বলেছেন, মতিঝিলে আইডিয়াল স্কুলের সামনে সমাবেশের অনুমতি দিলে তাঁরা মেনে নেবেন। এতে লাঠিও ভাঙল না, সাপও মরল। মঙ্গলবার রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পূর্বাভাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিএনপির সমাবেশে বাধা দিতে চাই না। একটা সমঝোতা হয়ে যাবে। দেশবাসীও চায় একটা সমঝোতা হোক।’
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা আশঙ্কা করেছিলেন যে বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দিলে তারা সেখানে অবস্থান নিতে পারে। ঢাকা শহরে অবরোধ অবস্থা তৈরি করতে পারে। বিএনপি অবরোধ অবস্থা তৈরি করবে কি, গত কয়েক দিনে পুলিশের বিশেষ অভিযান ও মোড়ে মোড়ে তল্লাশির কারণে এমনিতেই ঢাকায় একধরনের অবরোধ অবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক সংগঠন ১০ ডিসেম্বরের আগের কর্মসূচি স্থগিত করেছে। বলেছে, উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কর্মসূচি স্থগিত করা হলো। পরিবর্তিত তারিখ পরে জানানো হবে। পত্রিকা অফিসে অনেকে টেলিফোন করেও জানতে চেয়েছেন, ১০ ডিসেম্বর কী হবে?
এ প্রশ্নের উত্তর কেবল সরকারের জানা আছে। সরকার যদি বিএনপিকে তাদের প্রস্তাবিত বিকল্প স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়, তাহলে হয়তো কিছুই হবে না। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের ধারাবাহিকতায় তারা এখানেও একটি সমাবেশ করবে। কিন্তু সমাবেশের স্থান নিয়ে যদি ক্যাচাল চলতেই থাকে, পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। অগণতান্ত্রিক শক্তি তার সুযোগ নিতে পারে।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে জাতীয় সংসদ এলাকায় জিয়াউর রহমানের কবরস্থানে যাওয়ার বেইলি ব্রিজটি সরিয়ে নেওয়ার পর সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এ ঘটনা নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিএনপি আন্দোলন করেছিল। সরকারও তার অবস্থানে ছিল অনড়। সে সময়ে একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ লিখেছিলেন, বেইলি ব্রিজে আটকে গেল গণতন্ত্র। ২৫ বছর পর তার কথার পুনরাবৃত্তি করে প্রশ্ন করতে চাই, নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে সৃষ্ট বিবাদেই এবার গণতন্ত্র আটকে যাবে? বিরোধী দল সভা-সমাবেশ করার যে সীমিত সুযোগ পেত, তা-ও রহিত হয়ে যাবে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি