গতিপথ বদলে দেওয়া ৭ নভেম্বর

৭ নভেম্বরের মূল চরিত্র তিনজন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান, সাবেক ক্ষণস্থায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের
৭ নভেম্বরের মূল চরিত্র তিনজন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান, সাবেক ক্ষণস্থায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের

৭ নভেম্বর দেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়ার একটি দিন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে যে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা ঘিরে ধরেছিল, তার অবসান হয়েছিল ৭ নভেম্বর। ৭ নভেম্বরের মূল চরিত্র তিনজন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান, সাবেক ক্ষণস্থায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের। তিনজনই সামরিক কর্মকর্তা।

আপাতদৃষ্টিতে ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহকে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব মনে হতে পারে। এটা ঠিক, সংকটের শুরু জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সংকট বা দ্বন্দ্বটা যদি হয় জেনারেল জিয়া ও জেনারেল খালেদের মধ্যে, তবে মধ্য থেকে এই সংকটে আবির্ভূত হয়েছিলেন কর্নেল তাহের ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় নিয়ে। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন খালেদ মোশররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। জাসদ বিপ্লব বা অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করলেও এ ঘটনাকে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা বলেই মনে করেন অনেকে।

ওই সময়ের ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত বই, পর্যালোচনা, সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করলে এ কথা বলা অসংগত হবে না যে জাসদ বা তাহেরের পক্ষে এককভাবে কোনো ধরনের অভ্যুত্থান সংগঠনের সক্ষমতা ছিল না। কর্নেল তাহের জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতার পাখি শিকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘটনাপ্রবাহের শেষ অঙ্কে জেনারেল জিয়াউর রহমান নেতার ভূমিকায় উপস্থিত হন এবং সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। জিয়া সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন, যে কারণে শেষ পর্যন্ত কর্নেল তাহের আর টিকতে পারেননি। ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে জাসদের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে পেছনের দরজার বা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দিয়ে জাসদ বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি।

জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিল। জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতেই বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গে থাকে। জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের অমিত সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। মূলত এসব কারণে জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের একধরনের আস্থা ছিল। এ আস্থাই ১৯৭৫-এর নভেম্বরে জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতার দিকে নিয়ে আসে।

প্রতিবছরই ৭ নভেম্বর এলে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা হয়। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করা হয় কে কাকে উদ্ধার করেছেন। কে কাকে হত্যা করেছেন এসব নিয়ে বিস্তর আলাপও হয়। দিনটি বিএনপি ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে। জাসদও ‘বিপ্লব দিবস’ হিসেবে পালন করে। আওয়ামী লীগ সম্প্রতি ‘মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হত্যা দিবস’ হিসেবে দিনটিকে পালন করা শুরু করেছে।

এখানে তিন পক্ষের মধ্যে দুই পক্ষ বিএনপি ও জাসদ ৭ নভেম্বরকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে পালন করে। কিন্তু জাসদ শেষ পর্যন্ত বিপ্লবকে ধরে রাখতে পারেনি। জাসদ কি আসলেই বিপ্লব করেছিল, না সুযোগের ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, তা ইতিহাসের নির্মোহ অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। স্বাধীনতার পরপরই হত্যা, হামলা, জখমের কর্মসূচি নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয় জাসদ। পরবর্তী সময় জাসদ এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে আর বের হতে পারেনি। ওই সময়ের হাজারো মেধাবী তরুণকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে বিপথে ঠেলে দিয়েছিল জাসদ। মেধা ও তারুণ্যের নিদারুণ অপচয় হচ্ছে জাসদ। এ কারণেই ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহে জাসদ পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পায়নি। জাসদ সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

যেকোনো বিপ্লবের পূর্বশর্ত হচ্ছে জনমত ও জনবলকে সংগঠিত করা। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর জাসদের নিজস্ব জনবল যথেষ্ট ছিল না। তাই জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান জাসদের রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। ওই সময়ের জাসদের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে জাসদ এই অভ্যুত্থানে জড়িত হয়নি। বরং কর্নেল তাহের ও গুটি কয়েকজনের সিদ্ধান্ত এই ঘটনায় জড়িয়ে যায় জাসদ।

প্রথমা থেকে প্রকাশিত জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি গ্রন্থে মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ৭ নভেম্বর সকালে কর্নেল তাহের ও হাসানুল হক ইনু সেনানিবাসে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে যান। ওই সময় জিয়া জাসদের মূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু সিরাজুল আলম খান তখন নিরুদ্দেশ ছিলেন। তাঁর এই অদৃশ্য হওয়া থেকে ধারণা করা হয়, সিরাজুল আলম খান তাহেরের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন এবং এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে জড়াতে চাননি। এভাবেই কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের মূল্য চোকাতে গিয়ে জাসদের রাজনীতির শেষের ধাপ শুরু হয়ে যায় ঠিকমতো বিকশিত হওয়ার আগেই।

জাসদের পক্ষ থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগটা রক্ষা করতেন মেজর( অব.) জলিল। কিন্তু জলিল কারান্তরীণ হলে কর্নেল তাহের এ দায়িত্ব লাভ করেন। এরপরই তিনি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভকে উসকে দিয়ে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নাম দিয়ে একধরনের গণবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে ওই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনীকে ব্যবহার করে পাল্টা অভ্যুত্থান করেন। কিন্তু কর্নেল তাহেরের হিসাবে বড় ধরনের ভুল ছিল। সামরিক বাহিনীতে জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা এবং সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্ভবত তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সৈনিকদের ওপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। খালেদ মোশাররফও একই ভুল করেছিলেন। সেনাবাহিনীর অবস্থান ও জিয়ার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সম্ভবত তিনিও ভুল হিসাব করেছিলেন। যে কারণে দুজনই ৭ নভেম্বরে ঘটনার আড়ালে চলে যান। খালেদ মোশাররফ নির্মমভাবে নিহত হন এবং কর্নেল তাহের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরে যান।

কারণ, দুজনের প্রতি সামরিক বাহিনী বা জনসাধারণের বড় অংশের সমর্থন ছিল না; বরং অভাবনীয়ভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন। জাসদ দাবি করে, তাঁরাই জিয়াকে উদ্ধার করেছেন। জাসদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বরং জিয়ার জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে জাসদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ নিয়েছিল। কিন্তু সৈনিক সংস্থা কর্তৃক সামরিক বাহিনীর অফিসার হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত কর্নেল তাহের বা জাসদ ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন। বরং সামরিক বাহিনী ও জনসাধারণের সম্মিলিত উদ্যোগের কারণে জাসদের সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিল। জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতেই বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গে থাকে। জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। মূলত এসব কারণে জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের একধরনের আস্থা ছিল। এ আস্থাই ১৯৭৫-এর নভেম্বরে জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতার দিকে নিয়ে আসে।

এবারের নভেম্বরে অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে চরম শঙ্কায় পড়েছে দেশ। কী হবে —এক অজানা আতঙ্ক জনমনে। ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক