এ বছর ইলিশ যেন দূর আকাশের তারা হয়েই রইল। কেবল তাকে দেখা যায়, দূর থেকে ভক্তি-নিবেদনও করা যায়; কিন্তু ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশভাজা-শুকনা মরিচ পাতে ওঠে না।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে আমাদের এক বন্ধু বলছিলেন, এ মৌসুমে একটা ইলিশও তিনি কিনতে পারেননি। অথচ তাঁর ভাবনায় কতভাবে আসে মাছটি! এই সোমবার আমাদের একজন কনিষ্ঠ সহকর্মী বলছিলেন একই কথা। এ মৌসুমে একটা মাছও তাঁর থলেতে ওঠেনি।
কেবল এ দুজন নন, এ বছর এমন গল্পের পাণ্ডুলিপি লেখা হচ্ছে হররোজ। মহার্ঘ বস্তুটি, যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে কত কাব্যকথা, সাধারণের পাতে উঠছে না। ইলিশভাজার মৌতাতে মাতোয়ারা হচ্ছে না জনপদ। বাঙালি এখন ইলিশ নিয়ে আর কাব্য শুনতে চায় না, বাজারে গিয়ে মাছ কিনে ভেজে অথবা ঝোল করে খেতে চায়।
কিন্তু হায় কপাল! মানুষ ভাবে কী আর হয় কী!
বাজারে এক কেজি আকারের ইলিশ ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকার নিচে নামলই না। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশও বিকোচ্ছে কেজি ১ হাজার ২০০-তে। এই অধম কলাম লেখক একাধিক দিন ইলিশ কেনার আশা নিয়ে বাজারে গিয়ে না কিনে ফিরে এসেছেন। কিংবা ‘মিনি সাইজ’-এর একটি বা দুটি কিনে এনে মুখরক্ষা করেছেন।
কিন্তু বাজারে ইলিশ যে একেবারে নেই, তা তো নয়। মৌসুমের শুরুর দিকে কম ধরে পড়েছে সত্য, কিন্তু পরে জালে তো উঠেছে, যদিও তা অন্যবারের চেয়ে অনেক অনেক কম। এক কেজির ওপরে বা দেড় কেজি আকারের ইলিশও বাজারে দেখেছি।
এ রকম আকারের একটা ইলিশের দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা। চারটে দশাসই ইলিশ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। যাঁরা এসব মাছ কিনতে পারছেন, তাঁরা কোন কোম্পানিতে চাকরি করেন, কোথায় সদাগরি করেন, আল্লাহই মালুম।
তবে তাঁরা কেউ মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেননি, এ শহরেই বাস করেন। দিন শেষে ইলিশে তো সবই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, কাড়াকাড়িও হচ্ছে, নিমেষে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে টুকরি। তাহলে! সম্পদের প্রকট বৈষম্যের সে আরেক গল্প আজ থাকুক।
প্রথম আলোর খ্যাতিমান প্রতিবেদক ইফতেখার মাহমুদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তাঁরও কথা, ইলিশ মাছের জন্য তেমন কোনো বিনিয়োগ লাগে না। পোনা কেনা লাগে না, খাবার দেওয়া লাগে না, মাছ বড় করে তোলার জন্য কোনো জনবলও লাগে না।
মাছ ধরার সময় কেবল জাল, মাঝিমাল্লাদের খাবার ও নৌযানের তেল খরচ। তাহলে এই মাছের দামের এমন রুদ্ররূপ কেন? কোনো যুক্তি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এ নিয়ে কিছু আলাপ পেড়েছেন। একটা দরকারি সেমিনার হোক—ইলিশের দাম এত বেশি কেন? সার্বিক চিত্র উঠে আসুক। কে করবে?
এ বছর নাকি নদীতে খুব কম মাছ ধরা পড়েছে। যা ধরা পড়েছে, তা সাগর থেকে এবং তা আকারে ছোট, জাটকার সমরূপ।
আমাদের নদীতে দূষণ আছে, এটা ঠিক। বিশেষজ্ঞরা এটাকে বড় কারণ বলে হাজির করেন।
দূষণ এবং স্রোতের গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নাকি ইলিশ নদীতে আসছে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নদীতে দূষণ তো নতুন কোনো সাবজেক্ট নয়। আমাদের মৎস্যজীবীরা যা হামেশা বলে থাকেন, আমরা ইলিশের ডিম পাড়া ও জাটকা ধরার সময় হিসাব করে মাছ ধরার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকি, সেই সময়ের মধ্যে গলদ আছে।
এ বিষয়ে বিশেজ্ঞরা কী বলবেন? আর গভীর সাগরে ভারত ও মিয়ানমারের নৌযান এসে ঠিক ওই সময়ে আমাদের সীমানা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে তো কোনো জোরালো পদক্ষেপ তো দেখি না। মাছ কম ধরা পড়ার এটা কি কারণ নয়?
এবার দুটো চিত্র হাজির করি।
এক. চাঁদপুরের একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বলছিলেন, আমাদের দেশের মাছ আমরা খাইতে পারি না। মাছ চলে যায় অন্য দেশে। পাশে দাঁড়ানো ইলিশ মাছের এক কারবারি বলছেন, ভারতে ইলিশ রপ্তানি হবে—এমন খবরেই দাম বেড়ে গেছে কেজিতে ১০০ টাকা করে। কী কাণ্ড!
দুই. কলকাতার মাছের বাজার। একজন হাঁকডাক করছেন, বাংলাদেশের মাছ চলে এসেছে। পদ্মার মাছ। বেশ সস্তা পাবেন। তাঁর কী উৎসাহ! দেখে ভালো লাগে।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে সরকার ভারতে ৩ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। অক্টোবর মাসজুড়ে ইলিশ রপ্তানি করা যাবে। মাঝে কয়েক বছর ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ ছিল।
এ মৌসুমে ইলিশের কারবার মোটামুটি শেষ। কারণ, এই অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকবে ২২ দিন। প্রজনন মৌসুম সামনে রেখেই মূলত এই নিষেধাজ্ঞা। প্রজনন মৌসুমের পরই শেষ হয়ে যাবে ইলিশের মৌসুম। এরপর শুরু হবে জাটকা ধরার ওপর ওপর দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র। ইলিশ নিয়ে উচ্ছ্বাস মূলত বাঙালিদের ভেতরই। আর পূজা তো দুই বাংলার মানুষের অভিন্ন সাংস্কৃতিক উপলক্ষ। সে ক্ষেত্রে এই সময়ে ইলিশ রপ্তানি সমর্থনযোগ্য। কেবল অর্থ আয় তো ইলিশ রপ্তানির উদ্দেশ্য নয়, উৎসবের রং আর ছড়িয়ে দেওয়াই এর পেছনে নিহিত।
কিন্তু ভারতে ইলিশ রপ্তানির খবরে আমাদের এখানে দাম বেড়ে যাবে, আমাদের দেশের মানুষেরা ইলিশ কিনতে না পেরে আক্ষেপ করবেন, এটা বড় পীড়াদায়ক। সরকারকে তাদের কথাও শুনতে হবে।
এ মৌসুমে ইলিশের কারবার মোটামুটি শেষ। কারণ, এই অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকবে ২২ দিন। প্রজনন মৌসুম সামনে রেখেই মূলত এই নিষেধাজ্ঞা। প্রজনন মৌসুমের পরই শেষ হয়ে যাবে ইলিশের মৌসুম। এরপর শুরু হবে জাটকা ধরার ওপর ওপর দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা।
তাহলে কী দাঁড়াল? ইলিশ দূর আকাশের তারা হয়েই রইল। ইলিশপ্রিয় ভাই ও ভগিনীদের আগামী মৌসুম পর্যন্ত ধৈর্য ধরা ছাড়া করণীয় কিছু দেখছি না।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
alim.zaman@prothomalo.com