নির্বাচনটা হবেই, কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না!

এখন মাঠে-ঘাটে-বাটে, বাজারে-মাজারে একটাই কথা—‘নির্বাচন’। গণতান্ত্রিক দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তর নির্বাচন হয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়ে জনগণ, তথা ভোটারের কাছে যায়। তাঁদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। ভোটের দিন ভোটাররাই ঠিক করেন, তাঁরা কাকে বেছে নেবেন। ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়েই নির্বাচনসংক্রান্ত সব তৎপরতা শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিটি নির্বাচনের রেশ থাকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত। পুরো মেয়াদে বিতর্ক চলতে থাকে—কে কত খারাপ নির্বাচন করেছে, নির্বাচনকে কালিমালিপ্ত করতে কে মৃত ব্যক্তিকে দিয়েও ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।

গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্টই হয় সমস্ত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানেই দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হয়। ভোটাভুটির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয়। সংসদ সদস্যরা যে দলেরই হোন না কেন, স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক কালে ব্রিটেনের তিনজন প্রধানমন্ত্রী— তেরেসা মে, লিজ ট্রাস ও বরিস জনসনকে পদত্যাগ করতে হয়েছে, নিজ দলের সদস্যদের অনাস্থার মুখে। ব্রেক্সিট ইস্যুতেও  লেবার পার্টি ও  রক্ষণশীল দলের সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিয়েছেন, কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। এ জন্য দলীয় সংসদ সদস্য পদ হারাতে হয়নি।

আমাদের দেশে সংসদ সদস্যদের সেই অধিকার ও স্বাধীনতা নেই। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সেটি রহিত করে দিয়েছে। এতে বলা হয়, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন অথবা সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’

আওয়ামী লীগের নেতারা একটি কথা খুব জোর দিয়ে বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আসতেই হবে। ২০১৪ সালের মতো বিএনপি এবার নির্বাচন বর্জন করলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি পড়বে কি না, তা জানি না। তবে এ কথা বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার যদি আগের দুই নির্বাচনের ধারায় তৃতীয় নির্বাচনটিও করে ফেলে, তাতে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হবে। চীন ও রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের শাসনপদ্ধতির কোনো ফারাক থাকবে না।

যে এলাকাবাসী একজন সংসদ সদস্যকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, দল না চাইলে তাঁদের পক্ষে কথা বলারও অধিকার তাঁর নেই। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ও ‘চেতনাবিরোধী’ দলগুলোর মধ্যে আশ্চর্য মিল আছে। কোনো দলই সংসদ সদস্যদের মাথার ওপর থেকে ‘ডেমোক্লেসের তরবারি’ নামাতে চায় না।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্ক–হানাহানির নজির নেই। আগের কথা বাদ দিলেও অন্তত ১৯৯১ সাল থেকে যে কয়টি নির্বাচন এ দেশে হয়েছে, সেসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার মানুষ জীবন দিয়েছেন। অনেকে নির্বাচনের পর আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই হানাহানির আশঙ্কা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতাদের এক কথা, সংবিধানের অধীনই নির্বাচন হবে। সময়মতো নির্বাচন হবেই। কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। কোনো দল নির্বাচনে না গেলে সেটি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর জবাবে বিএনপির নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনার সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, বিএনপি মাঠে যতই বড় কথা বলুক, তফসিল ঘোষণার পর ঠিকই নির্বাচনে চলে আসবে। ২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন বর্জন করলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। আমাদের রাজনীতির এ–ও একটি সমস্যা বটে। ক্ষমতাসীনেরা বরাবরই বিরোধী দলের অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। কিন্তু নিজেরা যে বালিয়াড়ির ওপর বসে আছেন, সেটা টের পান না।

বিএনপির নেতারা আগে বলতেন, বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে তাঁরা যাবেন না, করতেও দেবেন না। এখন তাঁরা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে। বিএনপির সাবেক এক সংসদ সদস্যের কাছে জানতে চাইলাম, নির্বাচনের বাকি মাত্র তিন মাস। অক্টোবরের শেষ কিংবা নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা হবে। আপনারা নির্বাচন ঠেকাবেন কীভাবে?
উত্তরে বিএনপির ওই নেতা বলেন, তিন মাস কম সময় নয়। দেখুন না এর মধ্যে কী হয়। আওয়ামী লীগের ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ফর্মুলা এবার কাজে আসবে না। বিএনপির জোট–সহযোগী আরেক নেতা একই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে তিন মাসও সময় লাগবে না; সরকার হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।

সরকার হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ুক আর না-ই পড়ুক, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে খারাপ, সেটা চারদিকে তাকালেই দেখা যায়। একদিকে বিনিয়োগে স্থবিরতা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। থেমে থেমে বাজারে তল্লাশি চালিয়ে, ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেঁধে দিয়েও সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম।
সমস্যা হলো এই দুর্ভাগা দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করা যায় না। ক্ষীয়মাণ বামপন্থী, প্রতাপশালী মধ্য ও ডানপন্থী— গত ৫২ বছরেও ঠিক করতে পারল না একটি নির্বাচন কীভাবে করবে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, নির্বাচনে জয়ের জন্য নানা কারসাজি করে। ক্ষমতার বাইরে থাকতে তারা যে কথা বলে, ক্ষমতায় গিয়ে তার উল্টোটিই করে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে কোনো পরামর্শ দেওয়াও বিপজ্জনক। তারা বলবেন, ‘আমরা আঁতেলদের সবক শুনতে চাই না।’ কিন্তু রাজনীতিকেরা যাঁদের আঁতেল বলে গালমন্দ করেন, তাঁরা তো দেশ চালান না। রাজনীতিকেরাই দেশ চালাবেন। তাহলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো কেন? এর একটিই উদ্দেশ্য—তাঁরা যে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নামে তামাশা করে চলেছেন, সেসব বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। সমালোচনা করা যাবে না। কেবল বাহবা দিতে হবে। বলতে হবে, আহা, বেশ বেশ!

আওয়ামী লীগের নেতারা একটি কথা খুব জোর দিয়ে বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আসতেই হবে। ২০১৪ সালের মতো বিএনপি এবার নির্বাচন বর্জন করলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি পড়বে কি না, তা জানি না। তবে এ কথা বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার যদি আগের দুই নির্বাচনের ধারায় তৃতীয় নির্বাচনটিও করে ফেলে, তাতে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হবে। চীন ও রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের শাসনপদ্ধতির কোনো ফারাক থাকবে না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    sohrabhassan55@gmail.com