‘বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতিকর আকার ধারণ করছে।’
‘বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতিকর আকার ধারণ করছে।’

মতামত

তাঁরা কেন যৌন নিপীড়কদের পক্ষে?

যৌন হয়রানির ঘটনায় গত সপ্তাহে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযুক্ত মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হলেও তাঁর পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর বলছে, সাজন সাহা নামের ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ বিভাগীয় প্রধান রেজুয়ান আহমেদের কাছে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি সাজন সাহার পক্ষ অবলম্বন করেন এবং ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

ওই ঘটনার কয়েক দিন পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবন্তিকা ফাইরুজ নামের এক শিক্ষার্থী অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় (আমার কাছে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি প্ররোচনাকারী শব্দ, যার ঘন ঘন ব্যবহার অন্যদের প্রভাবিত করে) মারা গিয়েছেন।

মারা যাওয়ার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ‘নোট’ লিখে যান, যেখানে তিনি তাঁর এক সহপাঠীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে এক সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়কদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কথাও জানিয়ে গেছেন।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর বলছে, অবন্তিকা গত বছরের নভেম্বর মাসে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে উত্ত্যক্ত করা ও হয়রানির অভিযোগ করেন প্রক্টরের কাছে। অভিযুক্ত ওই শিক্ষার্থী হয়রানি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে আবেদন করলেও সমাধান মেলেনি।

এই ঘটনার ডামাডোলে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এক আলোচনায় এসে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের এক শিক্ষার্থী ভয়ানক কিছু অভিযোগ তুলেছেন, যা আলোচনা করা জরুরি বলে মনে করছি।

ওই তরুণী দাবি করেছেন, কয়েক বছর আগে তাঁরই বিভাগের এক শিক্ষক তাঁকে যৌন নিপীড়ন করেছেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর তিনি নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।

ভীত ও আতঙ্কিত এই শিক্ষার্থী টেলিভিশনের ওই আলোচনায় বলেন, অভিযোগ দেওয়ার পর তাঁকে অন্যায়ভাবে মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য করা হয়েছে। বিভাগীয় প্রধানের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর তিনি যৌন নিপীড়কের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভুক্তভোগীকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছেন।

তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করার পরিপ্রেক্ষিতে মানসিকভাবে হতাশায় ভোগেন তরুণীটি। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পরও সমাধান মেলেনি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হুমকিধমকির ভয়ে ঘর থেকে বের হতেও ভয় পান বলে জানান তিনি। এমনকি মূলত যৌন নিপীড়নের কারণেই ছয় বছর ধরে স্নাতকের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি সেই শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতিকর আকার ধারণ করছে। নানা সময়ে শিক্ষক ও সহপাঠীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। অভিযোগ দেওয়ার পরও নিপীড়কদের পক্ষেই কথা বলার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। ফলে যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরা বছরের পর বছর ধরে বিচারের জন্য ধরনা দিলেও সেসব কোনো কাজে আসছে না।

অবন্তিকা বা আরও আরও শিক্ষার্থীর সঙ্গে যাওয়া বিষয়গুলো যখন গণমাধ্যমে আসছে, তখনই কেবল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সরব হতে দেখা যায়। এর বাইরে যাঁরা গোপনে অভিযোগ দিচ্ছেন, যাঁদের বিষয়গুলো গণমাধ্যমের বাইরে থাকছে, তাঁদের অভিযোগের সুরাহা আদৌও হচ্ছে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠছে।

বাধ্যতামূলক ছুটি বা তদন্ত কমিটি গঠনের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগগুলোর সমাধানে যেমন পথ দীর্ঘায়িত হয়, তেমনি অভিযোগ দেওয়ার পর মানসিক চাপে ভুক্তভোগীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ অসহনীয় হয়ে ওঠে। বিচারের সততার পরিবর্তে মিলছে শঠতা, ফলে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার কাছে নারী শিক্ষার্থীরা অসহায় হচ্ছেন কি না, তা ভাবার সময় এসেছে।

যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকছে, তাঁরা অনেক সময় শিক্ষক হওয়ার কারণে ক্লাস-পরীক্ষায় প্রভাবের ভীতি যেমন প্রকট, তেমনি যাঁদের কাছে অভিযোগ জমা পড়ছে, তাঁরা সহকর্মীদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। সাম্প্রতিক সময়ের যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলোর পটভূমি সে কথাই বলছে। আবার অনেক সময় রাজনৈতিক ও ক্ষমতাসীন সংগঠনের কেউ অভিযুক্ত হলে, তাঁর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার খবরও চাউর হচ্ছে। এমনকি তাঁদের হয়ে ভুক্তভোগীদের জন্য নানা জায়গা থেকে পরোক্ষ চাপ ও ভীতি প্রয়োগের চিত্রপটও প্রকট।

বাধ্যতামূলক ছুটি বা তদন্ত কমিটি গঠনের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগগুলোর সমাধানে যেমন পথ দীর্ঘায়িত হয়, তেমনি অভিযোগ দেওয়ার পর মানসিক চাপে ভুক্তভোগীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ অসহনীয় হয়ে ওঠে। বিচারের সততার পরিবর্তে মিলছে শঠতা, ফলে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার কাছে নারী শিক্ষার্থীরা অসহায় হচ্ছেন কি না, তা ভাবার সময় এসেছে।

জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি, বিবেকের মুক্তির জন্য যে চর্চার প্রয়োজন, তা থেকে পিছিয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও গোষ্ঠীবদ্ধ সুবিধার বিবেচনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে সাফাইয়ের বলি হচ্ছেন অবন্তিকারা। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করেও যখন মুক্তির আশা দেখছেন না, তখন স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথে পা দিচ্ছেন তাঁদের কেউ কেউ। আবার অনেকেই অভিযুক্ত শিক্ষকদের মতো ব্যক্তিদের ফাঁদে পা দিতেও বাধ্য হচ্ছেন।

গুটিকয় ক্ষমতাগ্রাসী মানুষের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র জ্ঞানের চারণভূমি এখন তৃণভূমিতে পরিণত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কেন শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে না? কেন অভিযোগ পাওয়ার পরই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না? কেন তদন্তের নামে বিষয়টিকে দীর্ঘায়িত করা হয়?

বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও যখন বুদ্ধির মুক্তি মেলে না, যুক্তির দ্বার খোলে না, অসততার সুতা কেটে আলোকিত হওয়ার মাল্যদান সম্ভব হয় না, তখন সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গলদগুলো আমাদের সামাল দিতে হবে। সন্তানেরা যখন শিখতে গিয়ে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, সহপাঠী কিংবা শিক্ষকদের ব্যক্তিগত আক্রমণে ওদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা অন্ধকারে, তখন ওরা কোথায় যাবে? কার কাছে বিচার চাইবে?

এসব ঘটনা থেকে মুক্তির জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা যেমন জরুরি, তেমনি জাতীয় যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলও থাকা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ অভিযোগ দিলে সেটার অনুলিপি চলে যাবে জাতীয় নিপীড়নবিরোধী সেলে। নিরপেক্ষ কমিটি দ্বারা পরিচালিত হবে সেই সেল। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পক্ষপাতমূলক আচরণ করার সুযোগ পাবে না। ফলে তারা রাজনৈতিক অক্ষ-পক্ষশক্তির প্রভাব থেকে যেমন মুক্ত থাকবে, তেমনি তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের গড়িমসি করার কিংবা নিপীড়কদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয় কখনো ভয়ের জায়গা হতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাস্তানি দেখানোর জায়গা নয়। রাজনৈতিক বা পেশিশক্তি প্রদর্শনেরও জায়গা নয়। বরং বিশ্ব নাগরিক হওয়ার তীর্থস্থান। এখানে নিপীড়কদের থাকার কোনো সুযোগ নেই।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করার খেসারতে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতিকর হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনোই জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না। মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ক থেকে মুক্ত ক্যাম্পাস প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন। আমরা চাই অবন্তিকাদের জন্য একটি নিরাপদ শিক্ষালয়, যেখানে তাঁদের সম্মান ও অধিকার প্রদানে কেউ পিছপা হবে না।

  • ড. নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: nadim.ru@gmail.com