মতামত

ব্রিকস: জোহানেসবার্গে বাংলাদেশের কেন আশাভঙ্গ

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ব্রিকস সম্মেলন
ছবি: এএফপি

তিন দিনের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন হয়ে গেল (২২ থেকে ২৪ আগস্ট ২০২৩) দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে। সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। ঝামেলা এড়াতে তাই তিনি নিজে না এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। সম্মেলনে অবশ্য পুতিন ভার্চ্যুয়ালি তাঁর বক্তব্য দেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট আফ্রিকার সব রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে আর সেই সঙ্গে আফ্রিকার বাইরের আরও কটি দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে সম্মেলনে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করেছিলেন। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানও তার মধ্যে ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে অতিথি হিসেবে অংশ নেন। সম্মেলনের শেষ দিন ২৪ আগস্ট ছয়টি দেশকে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। দেশগুলো হচ্ছে আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও ইথিওপিয়া। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তি কার্যকর হবে।

২০০১ সালে গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল উন্নত বিশ্বের জি-৭ গ্রুপের বাইরে উন্নয়নশীল চারটি উদীয়মান অতি বৃহৎ অর্থনীতির দেশ একটি গ্রুপভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেন, যারা কালে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্তা হয়ে উঠবে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন—এই চার রাষ্ট্রের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে তিনি ব্রিক (BRIC) শব্দবন্ধ তৈরি করেন।

১৬ জুন ২০০৯ রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে ব্রিকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেওয়ার পর এস আদ্যক্ষর যুক্ত হয়ে নাম হয় ব্রিকস। পরবর্তী ১২ বছর আর কোনো দেশকে ব্রিকসের সদস্যভুক্ত করা হয়নি। বস্তুত ব্রিকসে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তিই খানিকটা অস্বাভাবিক ছিল। জনমিতি বা অর্থনীতির আকার—কোনো বিচারেই দেশটি বাকি চার দেশের সঙ্গে তুলনীয় ছিল না।

গত জুনে জেনেভায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে আগস্টে অনুষ্ঠেয় শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ আরও আটটি দেশ ব্রিকসের সদস্য হিসেবে গৃহীত হবে। পরবর্তী দুই মাস এ নিয়ে ঢাকায় বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। এমনকি অতি উৎসাহী কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে টানাপোড়েন চলছে, তাতে ব্রিকসের সদস্যপদ লাভের ফলে বাংলাদেশের অবস্থান সংহত হবে।

সম্মেলনের কাছাকাছি এসে অবশ্য মনে হচ্ছিল যে ভারত ও ব্রাজিলের আপত্তিতে সম্ভবত এবার কোনো নতুন সদস্য নেওয়া হবে না। তবে যদি নতুন সদস্য নেওয়া হয়, বাংলাদেশ সেই তালিকায় থাকবে, এ প্রত্যাশা ছিল। সম্মেলন শুরুর পর প্রথমে সম্প্রসারণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় এবং শেষ দিনে ছয়টি দেশকে নতুন সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ নেই সে তালিকায়।

ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত ছয়টি দেশের দিকে তাকালে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। দেশটির অর্থনীতিও বেশ উন্নত। বাকি পাঁচটি দেশই মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় পরস্পরের প্রায় গা ঘেঁষে অবস্থিত। মিসর সবচেয়ে বড় আরব দেশ। সৌদি আরবের অর্থবিত্ত ও তেলের মজুতের কারণে সবাই দেশটিকে খুশি রাখতে চাইবে। আমিরাত একটি ক্ষুদ্র দেশ, কিন্তু তার প্রভাব সব সময়ই তার আকারের চেয়ে অনেক ওপরে। ইরানের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক চীন-রাশিয়ার, আর সেই সঙ্গে ভারতেরও। সৌদি আরবকে নেওয়ার পাশাপাশি একটা ভারসাম্যের ব্যাপারও থাকতে পারে।

যখনই হোক, বাংলাদেশ একসময় এ জোটের সদস্য হবে, সে আশা করাই যায়। এ ধরনের জোটে ছোট-বড় সব দেশই একধরনের ভেটো-ক্ষমতা রাখে। সুইডেনের ন্যাটোভুক্তি যেমন তুরস্ক একাই আটকে দিতে পেরেছিল। এবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী দেশ ছিল পাঁচটি। আমরা তাদের সবাইকে পক্ষে নিতে পারিনি। এরপর তো সিদ্ধান্ত নেবে ১১টি দেশ। তাদের সবাইকে কি উদ্বুদ্ধ করতে পারবে বাংলাদেশ?

কিন্তু ইথিওপিয়া কেন? দেশটির অর্থনীতির আকার বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ, মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেকের কম। সেই সঙ্গে আছে চলমান গৃহযুদ্ধ। লোকসংখ্যা অনেক, তবে সেখানেও নাইজেরিয়া এগিয়ে। ইথিওপিয়ার অন্তর্ভুক্তির কারণ সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার শক্ত সমর্থন। সেখানে চীনা বিনিয়োগও অনেক। কোন কোন দেশকে নেওয়া হবে, তা নিয়ে দর-কষাকষি হয়েছিল অবশ্যই। আর সেখানে সরাসরি বিরোধিতা যদি না-ও হয়ে থাকে, বাংলাদেশের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়ায়নি কেউ। আমাদের ‘পরীক্ষিত বন্ধুরা’ আবার হতাশ করেছে বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশ যে সম্প্রসারিত ব্রিকসের সদস্য হতে পারেনি, বাস্তবে কি তাতে তেমন কিছু আসে-যায়? অস্তিত্বের এক যুগের বেশি সময়ে ব্রিকসের সাফল্যের তালিকা খুব বড় কিছু নয়। প্রাথমিকভাবে ব্রিকসের লক্ষ্য ছিল সদস্যদেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিনিয়োগ সুবিধাদির যথাযথ ব্যবহার এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে জি-৭ দেশগুলোর একক নিয়ন্ত্রণকে খর্ব করা। পশ্চিম-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সত্যিকারের কোনো ধাক্কা দিতে পারেনি এ জোট। কালক্রমে এ জোটে ভূরাজনৈতিক চিন্তাভাবনাও যুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিভিন্নমুখী এবং কখনো কখনো সাংঘর্ষিক স্বার্থের কারণে একটি ভূরাজনৈতিক জোটে পরিণত হওয়াও প্রায় অসম্ভব ব্রিকসের জন্য। এ ছাড়া জি-৭-ভুক্ত দেশগুলো যেমন আর্থরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেকটাই একই ঘরানার, ব্রিকস দেশগুলোর ক্ষেত্রে সে কথা খাটে না।

যেসব ইস্যু সামনে আছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ডলারের পরিবর্তে নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য এবং কারও কারও মতে ব্রিকসের অভিন্ন মুদ্রা চালু। দ্বিতীয়টির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত, তবে প্রথমটি খানিকটা শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। তবে ফলাফল হয়েছে মিশ্র। কিছুদিন আগে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন যে ভারতীয় রুপির স্তূপের ওপর তাঁরা বসে আছেন এবং তাঁরা জানেন না এ রুপি দিয়ে তাঁরা কী করবেন।

ধরা যাক, বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হয়েছে এবং স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করতে পারে। এই দেশগুলোতে আমাদের রপ্তানি কতটুকু যে আমদানির ব্যয় তাদের মুদ্রায় মেটাতে পারব? পশ্চিমের দেশগুলোর অর্থনীতি আমদানিমুখী এবং অভ্যন্তরীণ ভোগনির্ভর। এই জোটভুক্ত দেশগুলো তেমন নয়। ফলে সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত। বরং আমাদের রপ্তানি পণ্যও অনেক ক্ষেত্রে এসব দেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল বা মধ্যবর্তী পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। এসব দেশ থেকে আমদানির ব্যয় তাই আমাদের মেটাতে হবে পশ্চিমে রপ্তানি থেকে উদ্বৃত্ত ডলার, ইউরো দিয়েই। উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের একটা ব্যাপার অবশ্য আছে। তবে সেটা করবে ব্রিকসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশ এ ব্যাংকের সদস্য।

এত হই–হুল্লোড়ের পর সম্প্রসারিত ব্রিকসে স্থান লাভে ব্যর্থতা বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর অবশ্যই। এ ছাড়া শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জোট হিসেবে ব্রিকসের গুরুত্ব কালক্রমে বৃদ্ধিই পাবে, যেহেতু সদস্যদেশগুলোর অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল। তবে সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে এই তথ্যে যে আমরা একা নই, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া—এসব দেশও এবারের সম্প্রসারণে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা অবশ্য বলেছেন যে এটা শুধু শুরু, ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত হবে ব্রিকস। তবে সেটা কবে আর কী শর্তে হবে, তার কোনো ইঙ্গিত তিনি দেননি। যখনই হোক, বাংলাদেশ একসময় এ জোটের সদস্য হবে, সে আশা করাই যায়। এ ধরনের জোটে ছোট-বড় সব দেশই একধরনের ভেটো-ক্ষমতা রাখে। সুইডেনের ন্যাটোভুক্তি যেমন তুরস্ক একাই আটকে দিতে পেরেছিল। এবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী দেশ ছিল পাঁচটি। আমরা তাদের সবাইকে পক্ষে নিতে পারিনি। এরপর তো সিদ্ধান্ত নেবে ১১টি দেশ। তাদের সবাইকে কি উদ্বুদ্ধ করতে পারবে বাংলাদেশ?

● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব