তুরস্ক যখন ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকট ও বিরোধী দলগুলোর কার্যকর কৌশলের মুখে জনসমর্থন হারাচ্ছেন। এরদোয়ানের অধীন তুরস্ক গত এক দশকে জনমোহিনী কর্তৃত্ববাদের মডেল হয়ে উঠেছে। তবে বিরোধী ছয়টি দল সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা করে গণতন্ত্রীকরণ অ্যাজেন্ডা নিয়ে একটি বিরোধী জোট গঠন করেছে। তাদের সম্মিলিত চেষ্টা স্বৈরাচারী জনতুষ্টিবাদীদের রুখে দেওয়ার কৌশলনামায় নতুন অনেক কিছু যোগ করবে বলে ধারণা করা যায়।
বছরের পর বছর ধরে এরদোয়ান তাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসনে স্থূল সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ ঢুকিয়েছেন। তিনি নিজেকে এবং তাঁর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে (একেপি) দেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, সব বিরোধী দলের বৈধতা বাতিল করেছেন এবং বিরোধী অনেক নেতাকে বন্দী করেছেন। সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও গণভোটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একেপি নির্বাহী বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করেছে এবং তা করতে গিয়ে দলটি তুরস্কের রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণকে আরও গভীর খাতে ফেলে দিয়েছে।
একেপি পার্টির ক্ষমতা দখল একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েছে ২০১৮ সালে। ওই সময় এরদোয়ান তুরস্কের সংসদীয় ব্যবস্থার জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্যকে উড়িয়ে দিয়ে একটি জবাবদিহিহীন প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থা কায়েম করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বিলুপ্ত, সংসদকে নিষ্ক্রিয় ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের কাছে হস্তান্তর করে এরদোয়ান ভোটারদের সংগঠিত হওয়ার এবং এক ব্যক্তির নিরঙ্কুশ শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতাকে পদানত করেছেন।
কিন্তু বিরোধীদের ভয় দেখানো, তাদের চুপ করিয়ে রাখা, বিভক্ত করা, জাতীয় কার্যক্রম থেকে তাদের বাদ দেওয়া এবং তাদের নিরন্তর অপরাধী সাব্যস্ত করার চেষ্টা সত্ত্বেও তুরস্ক গণতান্ত্রিকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। সাম্প্রতিক জরিপগুলো ইঙ্গিত দেয়, বিরোধী দলগুলোর প্রতি ধারাবাহিকভাবে জনগণের সমর্থন বৃদ্ধি এরদোয়ান এবং ক্ষমতাসীন একেপি ও বর্তমান জোটের অংশীদার ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে, বিরোধী দল তাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে।
অন্যান্য দেশে যেভাবে গণতান্ত্রিক শক্তি জনতুষ্টিবাদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, তুরস্কের বিরোধীরা সেসব দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্যের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। তুরস্কের ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো সংসদীয় আসন জিততে একে অন্যকে সহযোগিতা করেছিল, কিন্তু এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দাঁড় করানোর বিষয়ে এক হতে পারেনি এবং নিজ নিজ প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছিল। এটি যে পরাজয় ডেকে আনা কৌশল, তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে।
তুরস্কের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থ ও মতাদর্শের প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী দলগুলো নির্বাচন-পরবর্তী একটি সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে। এটি এরদোয়ান সরকারের মেরুকরণ নীতির বিরুদ্ধে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর বয়ান বা ভাষ্যের উত্থানেরও জোরালো ইঙ্গিত।
২০১৯ সালে বিরোধী দলগুলো স্থানীয় নির্বাচনে যৌথভাবে প্রার্থী দাঁড় করানোর বিষয়ে একমত হয়েছিল। কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ (এইচডিপি) অন্য কয়েকটি দল আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী জোটে না থেকেও বিরোধীদের সহায়তা করেছে। যেমন কিছু মেট্রোপলিটন নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী না দিয়ে তারা যৌথ প্রার্থীদের পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছিল। ফলে একেপি ইস্তাম্বুল, রাজধানী আঙ্কারাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং একজন অপরাজেয় নেতা হিসেবে এরদোয়ানের যে খ্যাতি ছিল, তা ভেঙে যায়। যদিও বিরোধী দলগুলো মাঝেমধ্যেই মেরুকরণের রাজনীতির কাছে নতি স্বীকার করেছে, তারপরও তাদের ‘চরমপন্থী বন্ধনের’ ইতিবাচক কৌশল সফল হয়েছিল। এখন এরদোয়ান তাঁর প্রেসিডেন্টশাসিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একটি অপ্রত্যাশিত পরিণতির মুখোমুখি হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য এখন তাঁকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট নিশ্চিত করতে হবে এবং তিনি আর বিরোধীদের খণ্ডিত ও বিভক্ত দশার ভরসায় নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না। এর কারণ, বিরোধীরা অবশেষে বুঝতে পেরেছে, পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতাই হবে এরদোয়ানকে পরাজিত করার মূল চাবিকাঠি।
২০১৯ সালের স্থানীয় নির্বাচনের পর থেকে এই সহযোগিতা একটি শক্তিশালী জোটে পরিণত হয়েছে। সেক্যুলারিস্ট রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি), গুড পার্টি (যারা এমএইচপি থেকে আলাদা হয়ে গেছে), ইসলামিস্ট ফেলিসিটি পার্টি, ডানপন্থী ডেমোক্রেটিক পার্টি (ডিপি) এবং একেপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্ম নেওয়া দুটি শাখা—ডেমোক্রেসি অ্যান্ড প্রোগ্রেস পার্টি ও ফিউচার পার্টি—এই ছয়টি বিরোধী দল তাদের মতপার্থক্য সরিয়ে রেখে একসঙ্গে কাজ শুরু করে। তাদের পরিকল্পনা হলো ২০১৮ সালের মতো এবার তারা আলাদা আলাদা প্রার্থী দেবে না। এবার তারা যৌথভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত করবে এবং নির্বাচনে জয়ী হলে তারা জবাবদিহি ও ভারসাম্যমূলক একটি নতুন শক্তিশালী সংসদীয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করবে।
তুরস্কের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থ ও মতাদর্শের প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী দলগুলো নির্বাচন-পরবর্তী একটি সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে। এটি এরদোয়ান সরকারের মেরুকরণ নীতির বিরুদ্ধে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর বয়ান বা ভাষ্যের উত্থানেরও জোরালো ইঙ্গিত। এ ছাড়া বামপন্থী দলগুলো এইচডিপির নেতৃত্বে আরেকটি নির্বাচনী জোট গঠন করতে একত্র হচ্ছে। এরদোয়ান তাঁর সমর্থকদের মনে এই ভয় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন, ‘আমি যদি হারি, তাহলে আপনিও হারবেন।’ অন্যদিকে বিরোধীরা একটি ভিন্ন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে। সিএইচপি নেতা ও বিরোধী দলগুলোর যৌথ সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কামাল কিলিসদারোগলু সম্প্রতি বলেছেন, বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে তিনি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও দমন-পীড়নের শিকার সব লোক ও গোষ্ঠীর জন্য সাধারণ ছাড় ঘোষণা করবেন।
তুরস্কের গ্রাহকনির্ভর অর্থনীতি এখন উচ্চবার্ষিক মুদ্রাস্ফীতিতে (বর্তমানে সরকারি হিসাবেই এই হার ৮০) আক্রান্ত এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য জনমনে ক্ষোভ তৈরি করেছে। এ অবস্থায় বিরোধীরা এরদোয়ানের ধর্মীয় ও আদর্শিক পরিচয়ের রাজনীতির পরিবর্তে রুটিরুজির ইস্যুকে সামনে আনছে। দৈনন্দিন আর্থিক সংকটের বিশ্বাসযোগ্য সমাধানের প্রস্তাব দিয়ে বিরোধীরা এরদোয়ানকে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, পড়াশোনার জন্য নেওয়া ঋণের সুদ বাতিল করাসহ তাদের কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য করছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিধিনিষেধ সত্ত্বেও প্রধান শহরগুলো চালানো এবং মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোয় বিরোধীদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে তারা দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম। এরদোয়ান হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবানের মতো বিরোধী শাসনকে দুর্বল করার চেষ্টায় স্থানীয় সরকারগুলোর তহবিল ও ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পরও সাম্প্রতিক জরিপগুলো দেখাচ্ছে, ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার মেয়র যথাক্রমে একরেম ইমামোলু ও মানসুর ইয়াভাস যথেষ্ট জনপ্রিয়। এটি এরদোয়ানের জন্য অবশ্যই বড় ধরনের চিন্তার বিষয়।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
সেরেন সেলভিন কোর্কমাজ ইস্তাম্বুলভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইস্তানপোল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। একই সঙ্গে তিনি স্টকহোম ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট ফর তুর্কি স্টাডিজের একজন গবেষক ও ওয়াশিংটন ডিসির মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের একজন অনাবাসিক ফেলো