২১ মার্চ ক্রেমলিনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন
২১ মার্চ ক্রেমলিনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন

পুতিনের বন্ধু নন সি চিন পিং

আবারও বিশ্ব পূর্ব ও পশ্চিমের শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা কি নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ নাকি আগের ঠান্ডা যুদ্ধের অবশেষ থাকা উত্থিত উত্তাপ? এর উত্তর দুটিই। ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে, বিশ শতকের সেই পরাশক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এখনো শেষ হয়নি। যদিও সেই দ্বন্দ্বে সামরিক ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই স্পষ্টত জয়ী পক্ষ রয়েছে। আর সেই পক্ষটি অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সেই অপমানের জ্বালা পুষে রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, অন্ততপক্ষে জাতীয় কল্পনার ক্ষেত্রে।

রাশিয়া এখনো সেই ধারণা পুষে রেখে বিশ্বে একটা উপদ্রব তৈরি করছে। পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশের যদি অন্য দেশের ভূমি গ্রাসের ক্ষুধা থাকে তাহলে এটা উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন ক্রেমলিনের কাছে অনেক অতীতের একটা কল্পনা। নিকট ভবিষ্যতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা চীনেরও একমাত্র রয়েছে।

এই সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিং পিং যে মস্কো সফর করছেন, সে ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষাপটটা বিবেচনা করা অত্যন্ত আবশ্যক। এ সফরকে কেন্দ্র করে ক্রেমলিন প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে। তারা চিত্রিত করতে চাইছে যে এ সফর মস্কোর সঙ্গে বেইজিংয়ের গভীর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। এটা নিশ্চিতভাবেই রুশদের ক্ষতবিক্ষত অহম থেকে তৈরি করা কল্পকাহিনি। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বন্ধু নন। বরং তিনি একজন পৃষ্ঠপোষক, যিনি তার মক্কেলের কাছ থেকে সম্মান নিতে এসেছেন।

পশ্চিমা দেশগুলোতে সামাজিক উদারনীতিবাদের জয়জয়কার দেখে যারা তিতিবিরক্ত, তারা পুতিনকে তাদের ট্রল প্রকাশের জন্য রাজার আসনে বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ায় যে বাস্তবতা, তাতে পুতিনের সরকারকে সরকার না বলে সেটিকে সরকারের আদল বলাই শ্রেয়। প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল অপচয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ এবং সংখ্যালঘুদের বলির পাঁঠা বানানোয় দিনে দিনে দেশটি দুর্বলতর ও গরিবতর হয়েছে।

ইউক্রেনে আগ্রাসন রাশিয়ার একটি মহাভুল। এই আগ্রাসন শুরুর আগে পুতিনের কাছে বিকল্প ছিল। প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করে পশ্চিমাদের কাছে তিনি তাঁর অবস্থান পোক্ত করছিলেন। অথচ পুতিন এখন অনেক দেশের জন্য সস্তায় পেট্রলস্টেশন খুলে বসা একজন যুদ্ধাপরাধী, যিনি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করেন। আর তাঁর অতিরিক্ত ব্যবসা হলো, যুদ্ধবাজদের কাছে ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহ করা।

একটা জীবন্ত সত্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যতটা ভাবে ততটা একঘরে নন পুতিন। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটোর আগ্রাসনের ফল—মস্কো পক্ষপাতদুষ্টের মতো করে বারবার করে এই বয়ান দিয়ে চলেছে। তাঁর এই মতটি দক্ষিণ বিশ্বে ভালোই বিকোচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমাদের সামরিক ঔদ্ধত্যের যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের কাছে। আর অন্যদের কাছে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ ইউরোপীয়দের সংকীর্ণ জাতিবিবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে পক্ষ নেওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার সম্পদের ক্রেতা তৈরি হচ্ছে, টেকসই কোনো মিত্র নয়। উদার গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে সে রকম কোনো সুসংগত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মডেল রাশিয়া কিংবা চীনের নেই।

মতাদর্শ হিসেবে অচল হওয়া সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের মতাদর্শকে কোনো একটি দেশের স্বার্থের চেয়েও মহত্তর বিষয় হিসেবে দেখাত। সমাজতন্ত্র ছিল তাদের কাছে বৈশ্বিক ধর্মমত। পুতিনবাদ অবশ্য সে রকম মহত্তর কিছু দাবি করে না। এটা স্বজনতোষণবাদ ও রক্তপিপাসু জাতিবাদের সংকর। অবশ্য পুতিনের উপচে পড়া ভক্তকুলের কমতি নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অতি ডানপন্থীদের মধ্যে পুতিনের সংকীর্ণ ও বিষাক্ত বক্তব্যের প্রচুর শ্রোতা রয়েছে। পশ্চিমের ডিজিটাল তথ্যভান্ডারে অপতথ্য ছড়িয়ে এবং নির্বাচনী প্রচারণায় কালোটাকা ঢেলে ক্রেমলিন নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে।

পশ্চিমা দেশগুলোতে সামাজিক উদারনীতিবাদের জয়জয়কার দেখে যারা তিতিবিরক্ত, তারা পুতিনকে তাদের ট্রল প্রকাশের জন্য রাজার আসনে বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ায় যে বাস্তবতা, তাতে পুতিনের সরকারকে সরকার না বলে সেটিকে সরকারের আদল বলাই শ্রেয়। প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল অপচয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ এবং সংখ্যালঘুদের বলির পাঁঠা বানানোয় দিনে দিনে দেশটি দুর্বলতর ও গরিবতর হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে রাশিয়ার একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একনায়কতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে শিল্পায়নের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধ অবসানে গণতান্ত্রিক শিবিরের যে জয়জয়কার সেখানে এ ধরনের কিছু বিবেচনা করা ছিল অসম্ভব। তত্ত্বটি হলো, মার্ক্সীয় অর্থনীতি থেকে উত্তরণকালে রাষ্ট্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটানো। এর ফলে চীনে সম্পদে ধনী একটি মধ্যশ্রেণির জন্ম হয়। তারা সম্পতির অধিকার, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার আওয়াজ তোলেন। মোদ্দাকথা হলো, গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ অবিচ্ছিন্ন এক সত্তা।

এ ছাড়া ইন্টারনেটের দুনিয়া সীমানাহীন। সেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ কারিগরিভাবেই অসম্ভব। তিয়েনআনমেন গণহত্যা পরবর্তী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রজন্মের কাছে আপনি আর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি শুনতে পাবেন না। আর পশ্চিমা ভোক্তারা বেইজিংয়ে অবস্থিত টিকটকের জন্য উন্মাদ।

একান্ত বৈঠকে পুতিন–সি চিন

সম্ভবত এই হিসাব–নিকাশ এখন শিকেয় তুলে রাখতে হবে। গত বছরের শেষ দিকে চীনে অপ্রত্যাশিতভাবে যে লকডাউনবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, তা দেখে মনে হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টির এই কড়াকড়ি রকম নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কতটা চাপে আছে।
আবাসন খাতের ফুলেফেঁপে ওঠা বুদ্‌বুদ বিস্ফোরণ হলে আকস্মিকভাবেই চীনের অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়ে। এতে সি চিন পিংয়ের শাসনের কেন্দ্রীয় মিথটি ভেঙে পড়ে। আর সেই মিথটি হলো, স্বৈরশাসকেরা হলেন সবচেয়ে সেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপক।

এর পেছনে যুক্তিটা হলো, গণতান্ত্রিক শাসকদের ভোটারদের মনতুষ্টির প্রতি নজর দিতে হয়, সে কারণে তাৎক্ষণিক চাওয়া পূরণেই তাঁরা মনোযোগী থাকেন। অন্যদিকে স্বৈরশাসকেরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারেন। কিন্তু এই যুক্তি বাস্তবে আসলে খাটে না। একটা কুৎসিত সত্য হচ্ছে, ভোটকেন্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা অস্থিরতার জন্ম হয়েছে। এর জন্য অবশ্য গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তি দাঁড় করানো যায় না। এটি বরং আমাদের গণতান্ত্রিক ও জনতুষ্টিবাদীদের মধ্যে পার্থক্যটাকে মনে করিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে উদার গণতন্ত্র মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সামাজিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করে। উদার গণতন্ত্র হলো, আমাদের উত্তরাধিকারী ও আমাদের ভাগ্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য বাহক।

আমরা নতুন যে নতুন যুগে প্রবেশ করেছি, সেখানে ওপর থেকে দেখে মনে হবে আমরা দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধে প্রবেশ করেছি। কিন্তু বৈশ্বিক শক্তিকেন্দ্রগুলোর দিক থেকে বাস্তবে এ ধরনের কোনো হুমকি নেই। কিন্তু সময়ের জটিল সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারা, জনতুষ্টিবাদের কাছে নতি স্বীকার করা— পশ্চিমা গণতন্ত্রের এ সব ব্যর্থতা থেকেই আজকের এই সংকট।

দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • রাফায়েল বেহর দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক