কয়েক দিন আগে প্রথম আলো কার্যালয়ে কয়েকজন তরুণ-তরুণী এসেছিলেন তাঁদের সমস্যার কথা জানাতে।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের সমস্যা কী?
তাঁরা বললেন, ‘আমাদের সমস্যার শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়েছি অনেক আগে। বাড়িতে মা–বাবার কাছে টাকা চাইতে পারছি না। অনেকের মা–বাবার টাকা দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। কেউ কেউ টিউশনি করে চলছেন। চাকরির দরখাস্ত করতে যে টাকা দরকার, তাও অনেকে জোগাড় করতে পারেন না। বেকার জীবন মানে অভিশপ্ত জীবন।
চাকরির আবেদন করতে কত টাকা লাগে? জবাবে একজন বললেন, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির আবেদন করতে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। মাসে তিন-চারটি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলে দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকা ফি বাবদ গুণতে হয়। এরপর চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া বাবদ আরও কয়েক হাজার টাকা খরচ। কোনো বেকার তরুণ-তরুণীর পক্ষে এটা জোগাড় করা কঠিন।
গত ২৫ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় বেকারদের আবেদনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য করে। যেখানে বেকাররা এমনিতেই চাকরির আবেদন ফি দিতে হিমশিম খান, সেখানে আবার ভ্যাটও ধার্য করা হলো! অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ চাকরির আবেদন মাশুলের সঙ্গে ভ্যাটের হার বসিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে। ভ্যাট আরোপিত হওয়ায় এখন সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরির আবেদনকারীদের ব্যয়ও বাড়বে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ভ্যাট আরোপিত হবে মূলত পরীক্ষার মাশুলের সার্ভিস চার্জের (টেলিটক বাংলাদেশের কমিশন) ওপর ১৫ শতাংশ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন ও পরীক্ষার ফি নেওয়া হবে। পরীক্ষার ফি বাবদ সংগ্রহ করা অর্থের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে টেলিকম বাংলাদেশকে দিতে হবে। ভ্যাট হিসেবে আদায় করা হবে কমিশনের ১৫ শতাংশ।’
নবম গ্রেডে চাকরিপ্রত্যাশীদের আবেদন ফি হবে ৬০০ টাকা। এর সঙ্গে টেলিকম বাংলাদেশের সার্ভিস চার্জ ১০ শতাংশ বা ৬০ টাকা। এই ৬০ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ বা ৯ টাকা ভ্যাট। অর্থাৎ নবম গ্রেডে চাকরিপ্রত্যাশীদের আবেদন করতে ৬৬৯ টাকা লাগবে।
দশম গ্রেডে চাকরিপ্রত্যাশীদের আবেদন ফি ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে ৫০ টাকা সার্ভিস চার্জ এবং ৭ টাকা ৫০ পয়সা ভ্যাট যোগ হবে। এই গ্রেডে চাকরিপ্রত্যাশীদের আবেদন করতে লাগবে ৫৫৭ টাকা ৫০ পয়সা। ১১ ও ১২তম গ্রেডে চাকরিপ্রত্যাশীদের ৩৩৪ টাকা ৫০ পয়সা, ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডে চাকরিপ্রত্যাশীদের ২২৩ টাকা ও ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের চাকরিপ্রত্যাশীদের ১১১ টাকা ৫০ পয়সা দিতে হবে।
সম্প্রতি রাজস্ব বিভাগ আরেক ঘোষণায় বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ড ফান্ডের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কর বসিয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের মতো তাঁরা পেনশন পান না। তারপরও তাঁদের তহবিলে ভাগ বসানোর কী যুক্তি থাকতে পারে?
বেকার তরুণ-তরুণীদের প্রশ্ন, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ২০০ টাকা দিয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ করতে পারে, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কেন বাড়তি টাকা নেবে? পৃথিবীর অনেক দেশে চাকরির পরীক্ষার জন্য ফি নেওয়া হয় না। আবার অনেক দেশে ফি ধার্য করা হয় পরীক্ষার নিরিখে। যাঁরা যতটা পরীক্ষা দেবেন, তাঁদের ততটা পরীক্ষার ফি দিতে হবে।
কিন্তু আমাদের এখানে বিসিএস–এ আবেদনকারীদের প্রাথমিক, লিখিত ও মৌখিক—তিনটি পরীক্ষার ফি একসঙ্গে দিতে হয়। অথচ বিসিএসের বেশির ভাগ প্রাথমিক পরীক্ষায় বাদ পড়েন এবং তাঁরা পরবর্তী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সুযোগ পান না। এটাও বেকার তরুণ-তরুণীদের ওপর বাড়তি চাপ।
তাঁদের আরেকটি অভিযোগ, অনেক সময় একই দিনে তিন থেকে চারটি চাকরির পরীক্ষার তারিখ পড়ে। কিন্তু এক দিনে একজন চাকরিপ্রার্থীর পক্ষে একটির বেশি পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। এতে পরীক্ষার্থী অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিষয়টির প্রতি সরকার নজর দেবে বলে তাঁরা আশা করেন।
এই তরুণ-তরুণীদের আপত্তি কেবল আবেদনপত্রের বর্ধিত ফি নিয়ে নয়। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে ৩৫ করার দাবিতেও তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। মন্ত্রী-আমলারা বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দিলেও সেটি কার্যকর হয়নি। আন্দোলন করতে গিয়ে তাদের অনেকবার পুলিশের হামলার শিকার হতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একবার বেকার তরুণ–তরুণীরা জড়ো হতে থাকলে শাহবাগ থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এই বলে হুমকি দিয়েছিলেন যে, তাঁরা যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে জায়গা ছেড়ে না দেন, তাহলে গুলি করা হবে। বেকার তরুণ–তরূণীদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ কেবল অমানবিক নয়, নিষ্ঠুরও।
বয়সসীমা ৩৫ করার পক্ষে তাঁদের যুক্তি হলো, অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে করতে ২৬ থেকে ২৭ বছর লেগে যায়। ফলে চাকরির প্রস্তুতির জন্য শিক্ষার্থীরা সময় পান তিন থেকে চার বছর। দ্বিতীয় যুক্তি হলো করোনা মহামারিতে বলার মতো তেমন সার্কুলার আসেনি দুই থেকে আড়াই বছর। এতে সব ধরনের শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, সেই সময় যাঁদের বয়স ছিল ২৭ বা ২৮ বছর, তাঁদের ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য হলেও বয়স বাড়ানো জরুরি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৪০ বছর। বিশ্বের ১৬২টি দেশে সেই সীমা ৩০–এর ওপরে এবং কোনো কোনো দেশে বয়সসীমাও নেই। তবে বেশির ভাগ দেশেই তা ৩৫ বা এর ওপরে। ভারতে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা রাজ্যভেদে ৩৫ থেকে ৪৩ বছর পর্যন্ত রয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে মেধা ও দক্ষতা যাচাই করে বাস্তবতার নিরিখে বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে সরকার কিছুই করেনি। কেবল করোনার সময়ে নিয়োগ বন্ধ থাকায় আবেদন করার সময় কয়েক মাস বাড়ানো হয়েছিল।
বেকার তরুণ-তরুণীদের অভিযোগ, সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়ায় বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি বয়সসীমাকে অনুসরণ করে। বিশেষ করে ব্যাংক, বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩০-এর পরে নিয়োগ দিতে চায় না। তাঁদের প্রশ্ন, ৩০ পার হওয়া বিপুলসংখ্যক বেকার যাবেন কোথায়?
বেকার তরুণ–তরুণীরা প্রায়ই ই–মেইলে, টেলিফোনে এমনকি চিঠিপত্র লিখেও তাদের অভাব অভিযোগের কথা জানান। কবি সুবোধ সরকার রূপম নামে এক বেকার যুবকের জীবনকাহিনী তুলে ধরেছিলেন এভাবে:
রূপমকে একটা চাকরি দিন—এম.এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু’-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন।
বেকার তরুণ-তরুণীদের আক্ষেপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও তাঁরা এখন পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে আছেন। রূপমের মতো অনেকের প্রেম-সংসার ভেঙে গেছে বেকারত্বের কারণে। কেউ কেউ হতাশায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
পৃথিবীর অনেক দেশে বেকার ভাতা দেওয়া হয়। আমাদের সরকার সেটি দিতে না পারলেও অন্তত বেকারদের আবেদন ফির পরিমাণটা কমাতে পারে। বেকারদের ঋণ দিতে পারে যাতে তারা আত্মকর্মসংস্থান করতে পারেন। সরকারকে মনে রাখতে হবে, বিত্তবানেরা ব্যাংকের টাকা লুট করলেও গরিব কৃষক কিংবা বেকার তরুণ–তরুণীরা ব্যাংকের টাকা মেরে দেবেন না।
দেশের লাখ লাখ তরুণ–তরুণী যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে আছেন, তাদের প্রতি কি সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি