মতামত

বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে কর্তৃত্ববাদ মোকাবিলার নীতি কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে

এ লেখা যখন পড়ছেন, তখন বহুল আলোচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহূত দ্বিতীয় গণতন্ত্র সম্মেলনের প্রথম দিনের বক্তব্য সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে আপনারা জেনে গেছেন। আলাদা করে যুক্তরাষ্ট্রের এ গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজন নিয়ে দুই বছর ধরে অনেক বিতর্কই হয়েছে।

বিতর্ক এখনো চলছে, তবে ভিন্ন অগ্রাধিকার নিয়ে। দ্বিতীয় সম্মেলনটি এক বছর পর হওয়ার কথা থাকলেও তা তিন মাস পিছিয়েছে। সমালোচকেরা অবশ্য সময়ের দিক থেকে পেছানো নয়, সম্মেলনের লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকার দিকেই আঙুল তুলেছেন। ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে যুক্তরাষ্ট্রেরই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ট্রুম্যান সেন্টার ফর ন্যাশনাল পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট জন টেমিন লিখেছেন, দ্বিতীয় গণতন্ত্র সম্মেলনের কোনো প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন হচ্ছে কর্তৃত্ববাদ মোকাবিলার নীতি।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোও বলছে, সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলোর অনেকেই যে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে, তার তেমন একটা প্রমাণ নেই। সেখানে যারা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবায়নে অগ্রগতি যাচাইয়েরও কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই।

প্রথম সম্মেলনটি হয়েছিল ২০২১ সালের ৯ ও ১০ ডিসেম্বর। তখন অবশ্য বাংলাদেশে চাঞ্চল্য তৈরি হয় র‍্যাবের সাতজন কর্মকর্তা ও পুরো বাহিনীর ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণায়।

ওই সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্মেলনের আগে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যের কথা বলেছিলেন। সেগুলো হচ্ছে ১. কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই, ২. দুর্নীতি মোকাবিলা ও দমন এবং ৩. মানবাধিকারের প্রসার। বলা হয়েছিল, সম্মেলনের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যেসব দেশ অকৃত্রিম আগ্রহ প্রকাশ করবে, তাদের সবার সঙ্গে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। গত সম্মেলনে যারা আমন্ত্রিত হয়েছিল, এবারও তারাই আমন্ত্রিত, সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে মাত্র আটটি দেশ—বসনিয়ার হার্জেগোভিনা, লিখটেনস্টাইন, আইভরি কোস্ট, গাম্বিয়া, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, তাঞ্জানিয়া ও হন্ডুরাস।

দ্বিতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে যুক্তরাষ্ট্রের সহ-আয়োজক দেশগুলো কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আলাদা আলোচনা হওয়ার কথা, যার মধ্যে আছে ডিজিটাল যুগে গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে ইন্টারনেটের স্বাধীনতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার ও ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের উত্থান, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদীয়মান প্রযুক্তির রূপায়ণ, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তরুণদের ভূমিকার প্রসার, গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দুর্নীতির সমস্যা ও তা মোকাবিলার অগ্রগতি এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন।

গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়ে যেকোনো অর্থপূর্ণ সংলাপ অবশ্যই দেশভিত্তিক হতে হবে, সে দেশটি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পথেই থাকুক আর পশ্চাৎমুখীই হোক। ওই পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে নীতিনির্ধারকেরা বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে বাধ্য হবেন, যেটা বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনায় হয় না।’ কর্তৃত্ববাদীদের উত্থান মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চাপ এ সম্মেলনে কতটা প্রাধান্য পাবে, সবার নজর এখন সেদিকেই।

গণতন্ত্র সম্মেলন যে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সমালোচকদের সমালোচনার কারণও সেটাই। সম্মেলনে এমন অনেক দেশ আমন্ত্রণ পেয়েছে, যাদের এখন আর গণতান্ত্রিক বলা যাচ্ছে না। আবার একই রকম কর্তৃত্ববাদের উত্থানকে কারণ গণ্য করে বেশ কিছু দেশকে সম্মেলন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

সমালোচকেরা তাই বলছেন, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় বাইডেন প্রশাসন অনেকের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র থেকে পিছু হাঁটা ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার বিষয়কে উপেক্ষা করছে। গণতন্ত্রের জন্য বৈশ্বিক কৌশলের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা দপ্তর, অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য বিভাগ ও মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির অফিস—সবাই যদি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রবণতার বিষয়টিকে বিবেচনায় না নেয়, এতে সাফল্য মিলবে না বলেও তাঁদের মত।

কর্তৃত্ববাদী শাসকদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের নীতিতে অসংগতির কথা বলতে গিয়ে তাঁরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন সব সমালোচনা উপেক্ষা করে সৌদি আরব ও মিসর সফর করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। কিন্তু তাদের কাউকেই গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানে গণতন্ত্র ক্রমে দুর্বল হতে থাকার পরও তারা আমন্ত্রিত হয়েছে।

বাংলাদেশ এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় দেশে রাজনৈতিক বিতর্কও কম হয়নি। প্রথম সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে গণতন্ত্র সম্মেলনে ডেকেছে, যে কারণে আমন্ত্রিতদের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।’

কিন্তু দ্বিতীয় সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, ‘আপনি গণতন্ত্র কাকে শিখাইতে আসছেন? এ দেশের লোক গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছে।’ এখন জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে গণতন্ত্র এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে বলা হয়েছিল এবং প্রথমে সরকার আগ্রহ দেখালেও প্রতিশ্রুতি ও শর্ত পূরণে প্রস্তুত না থাকায় পরে পিছিয়ে গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র উদ্ধৃত করে সমকাল এ তথ্য লিখেছে।

২২ মার্চ ওয়াশিংটন ফরেন প্রেস সেন্টারে এ সম্মেলনের বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ কেন আমন্ত্রণ পায়নি, প্রশ্নটি করেছিলেন ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস–এর প্রতিনিধি প্রশান্ত ঝা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রব বারশেনস্কি আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বিশদ কিছু প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন যে তাঁরা শুধু বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শাসনের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও একটা বৃহত্তর সম্মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। আমন্ত্রণ জানানো না-জানানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের শাসনব্যবস্থার মূল্যায়ন করছে না।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে তাদের দেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অবস্থা সম্পর্কে আমরা আমাদের মতামত জানিয়েছি এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে কাজ করতে আমাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছি। এটা একটা প্রক্রিয়া। আমরা উন্নতি দেখতে চাই। এই মান যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে এবং ওই সরকারগুলোর সঙ্গে সংলাপে এটাই শেষ কথা নয়।

কূটনৈতিক এ জবাবে গণতন্ত্রের গুণগত মান সম্মেলনে আমন্ত্রণের বিবেচ্য নয় বলা হলেও ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অবস্থা সম্পর্কে সরকারকে মতামত’ জানানো এবং ‘উন্নতি দেখতে চাওয়া’র বক্তব্যেই স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এ বিষয় দুটির গুরুত্ব আলাদা।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছাবার্তায় গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে জোর দেওয়ার বিষয়টিও সেই ইঙ্গিত দেয়। এই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন বলতে যুক্তরাষ্ট্র কী বোঝাচ্ছে, তার একটা ব্যাখ্যাও মেলে ২২ মার্চ ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের এক সাক্ষাৎকারে। এতে তিনি বলেছেন, তাঁরা চান জাতিসংঘের স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্বাচন।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের যে কৌশলের আভাস বারশেনস্কির কথায় উঠে এসেছে, ঠিক সে রকম প্রতিটি দেশের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনার জন্য নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ বাড়ছে। শুরুতে ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে জন টেমিনের যে নিবন্ধের কথা বলেছি, তাতে তিনি লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য একটি বৈশ্বিক কৌশল যথেষ্ট নয়।

গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়ে যেকোনো অর্থপূর্ণ সংলাপ অবশ্যই দেশভিত্তিক হতে হবে, সে দেশটি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পথেই থাকুক আর পশ্চাৎমুখীই হোক। ওই পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে নীতিনির্ধারকেরা বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে বাধ্য হবেন, যেটা বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনায় হয় না।’ কর্তৃত্ববাদীদের উত্থান মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চাপ এ সম্মেলনে কতটা প্রাধান্য পাবে, সবার নজর এখন সেদিকেই।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক