সন্তান কেন মা বা বাবার হন্তারক হয়ে ওঠে

মাকে হত্যার পর গ্রেপ্তার মাঈনুদ্দীন মো. মাইনু
ছবি: সংগৃহীত

‘প্রিয় বাবা,

তোমার মৃত্যুর ঠিক এক মাসের মাথায় আমি নিজ হাতে পিস্তল দিয়ে মাকে হত্যা করেছি। আমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা কাজ করেনি। কিন্তু এখন বোধের উদয় হয়েছে। এ কী করলাম! যে মা আমাকে ১০ মাস গর্ভে ধারণ করেছেন, যে মা আমাকে দুই বছর ধরে দুধ পান করিয়েছেন, যে মা আমাকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত নিজ আঁচলে আগলে রেখেছেন, সেই মাকে আমি হত্যা করেছি! জগতের সব শাস্তি আমার প্রাপ্য। বাবা, তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলে না। আমি বখে গিয়েছিলাম। পথে আনতে বোনের কাছে অস্ট্রেলিয়াতেও পাঠিয়েছিলে। কিন্তু আমার উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কারণে দেশে আসতে বাধ্য হয়েছি। ভোগবাদী জীবন আর মাদক আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। আমার হিতাহিত জ্ঞান ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছিল।

আজ কারাগারের প্রকোষ্ঠে থেকে থেকে আমার বোধের উদয় হয়েছে। নিজকে ক্ষমা করতে পারছি না। কিন্তু আমার এ জীবনের জন্য কি আমি একাই দায়ী? নাকি আমার পরিবার ও সমাজের পরিবেশও এর জন্য দায়ী? বাবা, তুমিও কি এ দায় এড়াতে পারবে? তোমার ছোট্ট খোকা কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে—তুমি কি ঠিকমতো খেয়াল রেখেছিলে? মা কি খেয়াল রেখেছিল? হ্যাঁ, তোমরা যত দিনে আমার বখে যাওয়া টের পেয়েছ, তত দিনে আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। তোমাদের কথা পাত্তা দেওয়ার মতো অবস্থা আমার ছিল না। আমি ছিলাম খাঁচাভাঙা পাগলা কুকুরের মতো। কিন্তু তোমরা সঠিক চিকিৎসা না করে আমাকে আলতো করে বশে আনতে চেয়েছ। কিন্তু পারোনি। কারণ, এটা পারার কথা নয়। আমার অসুখ যেমন ছিল, চিকিৎসাও তেমন প্রয়োজন ছিল। তোমরা তা করোনি। পরিণামে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। আমি টাকা চিনেছি, ভোগের মজা বুঝেছি। কিন্তু মানুষ হইনি।
বলো, বাবা! তুমি আমার এ চিঠির কী জবাব দেবে?

—ইতি...।’

দুটি কেস স্টাডি—


এক.

প্রথম আলোর অনলাইনে ১৮ আগস্টের একটি শিরোনাম, ‘পটিয়ায় মাকে হত্যার ঘটনায় অস্ত্রসহ ছেলে গ্রেপ্তার’। অভিযোগ, গ্রেপ্তার মাঈনুদ্দীন মো. মাইনু ১৬ আগস্ট টাকা নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বে বোন ও মাকে গুলি করেন। এর মধ্যে মা জেসমিন আক্তার নিহত হন। ওই যুবক চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা প্রয়াত সামশুল আলম মাস্টারের ছেলে। ঘটনার পরদিন ১৭ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম নগরীর একটি এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
গ্রেপ্তারের পর মাঈনুদ্দীনের মানসিক অবস্থা নিয়ে আরেকটি গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিল, ‘মাকে গুলি করে হত্যা, গ্রেপ্তার ছেলের নেই অনুশোচনা’। এ প্রতিবেদনে র‍্যাবের চট্টগ্রাম জোনের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফের বক্তব্য এভাবে উদ্ধৃত করা হয়, ‘গ্রেপ্তারের পর মাঈনুদ্দীনের মধ্যে মাকে খুন করার জন্য কোনো ধরনের অনুশোচনা দেখিনি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি সে তার বাবার অফিস থেকে সংগ্রহ করেছিল।’

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে র‍্যাব কর্মকর্তা এম এ ইউসুফ বলেছিলেন, সামশুল আলম মাস্টার জীবিত থাকা অবস্থায়ই মাঈনুদ্দীন উচ্ছৃঙ্খল ও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ জন্য ছেলের ওপর তিনিও বিরক্ত ছিলেন। ছেলেকে বাদ দিয়ে তাঁর সম্পত্তি স্ত্রী ও মেয়ের নামে রেখে যান। গত ১৩ জুলাই সামশুল আলম মারা যাওয়ার পর তাঁদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ঘটনার দিন সকালে মেয়েকে নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলেন জেসমিন। সেটি জেনে মাঈনুদ্দীনের ধারণা হয়েছিল, তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর মা ও বোন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেছেন এবং সম্পত্তি বিক্রি করে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাবেন। সেটি নিয়ে দুপুরে ঘরে গিয়ে মা ও বোনের সঙ্গে ঝগড়া বাধান মাঈনুদ্দীন। একপর্যায়ে নিজের কোমরে থাকা পিস্তল বের করে বোনের দিকে গুলি ছোড়েন। সেটি তাঁর শরীরে না লাগায় আরেকটি গুলি ছোড়েন মায়ের দিকে।

দুই.

১৭ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একটি নিউজের শিরোনাম ছিল ‘মার্কিন নাগরিকের আইফোন পেয়ে ফিরিয়ে দিলেন রিকশাচালক’। পরদিন, তথা ১৮ আগস্ট খবরটি প্রথম আলোর নগর সংস্করণে প্রকাশিত হয় ‘আইফোন পেয়ে ফিরিয়ে দিলেন রিকশাচালক’ শিরোনামে। এরপর রিকশাচালক আমিনুল ইসলামকে নিয়ে আরও কত-কী হয়ে গেল, তা কমবেশি সবার জানা। সময়ের মুখ হিসেবে প্রথম আলোয় তাঁর সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছে। সততার দৃষ্টান্ত দেওয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম পুরস্কার হিসেবে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

আমিনুল ইসলাম আইফোন ফিরিয়ে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা এই নিবন্ধে আলোচনার বিষয় নয়। কারণ, এমন মহৎ দৃষ্টান্ত আমরা মাঝেমধ্যে দেখতে পাই। এর বেশির ভাগই খেটে খাওয়া মানুষেরা করে থাকেন। এই কাতারে অটোরিকশাচালক, ট্রাকচালক থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সমীকরণের অনেকেই রয়েছেন। সর্বশেষ ঠাকুরগাঁওয়ের ব্যবসায়ী যুবক শাকির হোসেন ওরফে সৌরভ মহাসড়কে কুড়িয়ে পাওয়া ৫ লাখ টাকা ফেরত দিতে রীতিমতো মাইকিং করে চলেছেন। আমিনুল ইসলামের যে কথা সামনে আনতে চাই, তা হলো, ‘গরিব হলেও অন্যের সম্পদে কোনো লোভ নেই। সৎ পথে যা আয় করি, তা দিয়েই সুখে আছি।’ আহ্‌! আমাদের মহারথী ও মহারথীদের পরিবারের সদস্যরা যদি এ কথা একটু মানতেন!

আমিনুল ইসলামের এ বক্তব্য থেকে ‘সুখ’ শব্দটি আলাদাভাবে আলোচনায় নেওয়া যেতে পারে। সুখ কী? সুখ কোথায় থাকে? সুখ পেতে কোথায় যেতে হয়? সুখ কি কেনা যায় ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে অনেকেই সুখের সঙ্গে টাকার মতো সম্পদের একটি যোগসূত্র খুঁজবেন। এ কথা অস্বীকারের জো নেই। কিন্তু এ কথাও ফেলে দেওয়া যাবে না যে টাকা বা সম্পদ হলেই সুখ পাওয়া যায় না। সুখ যাপিত জীবনের মৌলিক কিছু বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বন্ধন, কঠিন রোগমুক্ত জীবন, আইনসিদ্ধ ও নৈতিক উপার্জন, বিধিবদ্ধ ও নৈতিক ব্যয়, গভীর ঘুম, খাবারের হজম ক্ষমতা, মৌলিক চাহিদা পূরণের সক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়।

কিন্তু এমন হন্তারক তৈরির জন্য কি রাষ্ট্র দায়ী নয়? রাষ্ট্র তার কল্যাণমূলক চরিত্র হারিয়েছে। গুনে গুনে ভ্যাট-ট্যাক্স বুঝে নিলেও নাগরিকের প্রতি বরাবরই সে বেখেয়াল। এখানে সমাজেরও দায় আছে। আমাদের পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সম্প্রীতি দিন দিন কতটা ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই।

সুখের সঙ্গে যেমন সম্পদের যোগসূত্র রয়েছে, তেমনই সম্পদের সঙ্গে রয়েছে চাহিদার সম্পর্ক। আর এই চাহিদা ও সম্পদের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে ব্যক্তির সুখের একাংশ। কিন্তু এই একাংশে যদি লাগাম টানা না যায়, তাহলে সর্বনাশ; ব্যক্তির সুখের সর্বাংশ উচ্ছন্নে যাবে। সম্পদ ও চাহিদা প্রসঙ্গে গ্রিক দার্শনিক এপিকটেটাসের (৫৫-১৩৫ খ্রি.) একটি উক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। এপিকটেটাস বলেছেন, ‘সম্পদ আপনার চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। আপনার যা আছে, তার চেয়ে চাহিদা কম হলেই আপনি ধনী। আর আপনার যতই থাকুক না কেন, চাহিদা যদি তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আপনি দরিদ্র।’

মুদ্রাকে (টাকা) কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) দেখেছেন এভাবে, ‘টাকা মানুষের শ্রম আর সত্তার বিচ্ছিন্ন সারমর্ম; এই সারমর্ম নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে, আর মানুষ একে করে উপাসনা।’ মার্ক্সের এ কথার গুরুত্ব অনেক। অর্থের প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন এ ঝোঁক মানুষকে অনেক সময়ই অনর্থের দিকে নিয়ে যায়। যেমনটা নিয়ে গিয়েছে পটিয়ার মাঈনুদ্দীনকে।

কিন্তু এমন হন্তারক তৈরির জন্য কি রাষ্ট্র দায়ী নয়? রাষ্ট্র তার কল্যাণমূলক চরিত্র হারিয়েছে। গুনে গুনে ভ্যাট-ট্যাক্স বুঝে নিলেও নাগরিকের প্রতি বরাবরই সে বেখেয়াল। এখানে সমাজেরও দায় আছে। আমাদের পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সম্প্রীতি দিন দিন কতটা ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। অনৈতিকতার চর্চা, নীতিহীন ব্যবস্থাপনা ও মূল্যবোধের অভাব এ রাষ্ট্র ও সমাজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত। আর হ্যাঁ, ওপরের চিঠিটি কাল্পনিক। মাঈনুদ্দীন বেঁচে থাকা অবস্থায় মনে মনে হলেও এমন চিঠি লিখবেন বলে আশা করছি।

  • মো. ছানাউল্লাহ, প্রথম আলোর সহসম্পাদক