মতামত

‘কর্তৃপক্ষের’ কাছে কবে ‘পাত্তা’ পাবে শিশুদের জীবন

বাবার সঙ্গে দুই ভাই শাহির মোবারত (৯) ও শায়ান মোবারত (১৫); এই দুই ভাই এখন শুধুই স্মৃতি
 ছবি: সংগৃহীত

ক্ষমা করবেন। যে প্রসঙ্গে আমি কথা বলছি, তা অনেকটা নিষ্ঠুর ও অবিবেচনাপ্রসূত। ধরুন, আপনার দুটি সন্তান। আপনাকে একটি সন্তান বেছে নিতে বলা হলো। হলফ করে বলতে পারি, এমন কঠিন প্রস্তাবের মুখোমুখি আর কখনো হননি আপনি। নাহ, আপনি দুটি সন্তানের কাউকেই ছাড়তে পারবেন না।

অথচ এই আমরাই কিন্তু বলছি, আহা! শাহির মোবারত জায়ান (৯) কিংবা তার বড় ভাই শায়ান মোবারত জাহিনের (১৫) একজন বাঁচলেও তো চলত। ওদের মা–বাবা এখন কী নিয়ে বাঁচবে! এই যে চাওয়া, তাতে দোষ দেখি না। যে দেশে ডানে-বাঁয়ে কিংবা মাঝখানে অহরহ ‘অবহেলাজনিত’ মৃত্যু, সেখানে নিরুপায় মানুষের আর কীই–বা বলার আছে?

এই শাহির ও শায়ান ৫ জুন তাদের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় মারা যায়। ওই বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বিষক্রিয়ায় কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওরা দুই ভাই মারা যায়। ওদের বাবা মোবারক হোসেন ও শারমিন জাহান এখন সন্তানদের স্পর্শ খুঁজতে তাদের ব্যবহৃত জিনিস হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।

এই মা-বাবার হাহাকার আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল আরেক বাবা মো. শাহ আলমের কাছে। তাঁর ছেলের নাম নাঈম হাসান। দেড় বছর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হয় নটরডেম কলেজের এই ছাত্র। সে ঘটনায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জন্য আবারও নেমে এসেছিল শিক্ষার্থীরা। একহারা গড়নের নাঈমের মৃতদেহ যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের লাশের ট্রেতে, তখন ওর বাবা হাসপাতালের নোংরা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বলে চলেছেন, ‘আহ! আমার পাখিটা। বিদায় দিলাম, চিরবিদায় হয়ে গেল।’

এভাবে আর কত মা কত বাবা তাঁদের কলিজার টুকরাদের হারালে শিশুদের জীবন ‘কর্তৃপক্ষের’ কাছে ‘পাত্তা’ পাবে? এ প্রশ্নের জবাব কি কারও কাছে আছে? এই শিশুদের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া অসহায় মানুষের কীই–বা করার কাছে আর। খ্যাতনামা ব্রিটিশ গায়ক এলটন জনের ‘টিয়ার্স ইন হেভেন’ গানটা ঘুরেফিরে শুনি। শাহিল, শায়েন, নাঈম, নূপুর বা হাসান—নিশ্চয়ই দরজার ওপাশে শান্তিতে আছে। কারণ, স্বর্গে কোনো কান্না নেই।

শাহির, শায়ান বা নাঈমের মৃত্যু বিচ্ছিন্ন কোনো মৃত্যু নয়। গেল ৩১ মে এমনি এমনিই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে রড মাথায় ঢুকে মারা গেছে পথশিশু মো. হাসান। শিশুটির মাথার পেছন থেকে রড ঢুকে চোয়াল দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এক অসহনীয় কষ্ট নিয়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা বেঁচে ছিল সে। চিকিৎসকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি। তাদের সামনেই আস্তে আস্তে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে হাসান।

পথশিশু, তাই শেষ সময়ে পরিবারের কারও ভালোবাসার স্পর্শও জোটেনি ওর। এই অসহনীয় মৃত্যুর স্বাক্ষী মুশফিকুর রহমান নামের এক চিকিৎসক ফেসবুকে লিখেছেন, শিশুটির এই মৃত্যু সব নির্মমতার ঊর্ধ্বে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে রাজধানীর রূপনগরে গ্যাস বেলুন সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যায় নূপুরসহ আট শিশু। নানা রঙের, আকৃতির বেলুন দেখে হাসি হাসি মুখের ছোট্ট আর রঙিন শিশুরা বেলুন বিক্রেতার কাছে ছুটে গিয়েছিল। তারপরই তাদের নরম-কোমল একরত্তি শরীরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

এই মৃত্যুগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে খুঁজলে পাওয়া যায় কোনো না কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা বা অবহেলা। তারা কি আসলে শিশুদের ভালোবাসে? মানুষের জীবনের কি আসলে কোনো দাম আছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে?

অথচ কাগজে-কলমে বাংলাদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ শিশুদের ব্যাপারে খুবই মনোযোগী। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে শিশু আইন হয়েছে। সেই আইন আবার ২০১৩ সালে যুগোপযোগী করা হয়েছে। তাতে শিশু সুরক্ষায় কঠোর-কঠিন সব বিধি-বিধানের কথা আছে। শিশু আইনের ৭০ ধারায় শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর হলে জেল-জরিমানার বিধান আছে।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় দুই শিশুর মৃত্যু নিয়ে কথা বলেছিলাম বেশ কয়েকটি পক্ষের সঙ্গে। ওই বাসায় তেলাপোকা মারতে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছিল, ধারণা করা হচ্ছে, সেটি ছিল অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ এ ধরনের বালাইনাশকের অনুমোদন দিয়ে থাকে, হোক তা খাদ্যগুদাম বা চালকলে ব্যবহারের জন্য কিংবা বাসাবাড়িতে।

কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, সারা দেশে নিবন্ধিত ডিলারের মাধ্যমে অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট বিক্রি হয় শুধু খাদ্যগুদামে ব্যবহারের জন্য। এই ওষুধগুলো খাদ্যগুদামে প্রয়োগের ৭২ ঘণ্টা পর দরজা-জানালা খুলে গুদাম পরিষ্কার করে ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আছে। বাসাবাড়িতে উইপোকা, তেলাপোকা, ছারপোকা মারার প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট ব্যবহার করার কথা নয়। তাহলে কীভাবে তাদের হাতে যাচ্ছে এই ওষুধ?

কথাবার্তা বলে মনে হয়েছে, উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের নজরদারি ছিল ঢিলেঢালা। সারা দেশে ১১৮টি প্রতিষ্ঠান বাসাবাড়িতে তেলাপোকা, ছারপোকা, উইপোকাসহ যাবতীয় পোকা মারার জন্য নিবন্ধিত। দুই বছর পরপর তাদের এই লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছে, সে সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না।

এখন উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে লাইসেন্স বাতিল হবে।

কাকতালীয়ভাবে দিন দুয়েক আগেই সোফা, কার্পেট, ট্যাংক ও কিচেন ক্লিনিং, উইপোকা–তেলাপোকা নিধনের জন্য একটি নম্বরে যোগাযোগের কথা বলে বার্তা আসে আমার ফোনে। নম্বরটিতে যোগাযোগ করলে নুরুল আমিন নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি এই সেবা দেন। আগে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। এখন নিজেই প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের অনুমোদন তিনি নেননি। তারপরও কী করে খুদে বার্তা পাঠিয়ে খদ্দের জোগাড় করছেন নুরুল আমিন? উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ কি সেটা জানাবে আমাদের?

এভাবে চলছে আরও কত কিছু! এই তো নটরডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর পরপরই খবর বেরিয়েছিল, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চালান পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। পরপর কয়েক দিন ময়লার গাড়ির চাপায় আরও কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় সে সময় বেশ একটু শোরগোল হয়েছিল। তবে গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ড্রিঞ্জা চাম্বুগংয়ের ‘টাকার বিনিময়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বর্জ্যের গাড়ির চাবি দেওয়ার অভিযোগ’ প্রতিবেদনটিতে ঘুষ দিয়ে গাড়ির চাবি পাওয়ার ঘটনা বিশদে বেরিয়েছে। এ প্রতিবেদনে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁদের বেশ কয়েকজন অবলীলায় কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে গাড়ির চাবি পাওয়ার কথা বলেছেন।

অথচ নাঈমের মৃত্যুর পর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে উল্টো প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, ‘ময়লার গাড়ির সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যাবে কেন?’

শিশু হত্যার দায় এড়ানোর আরও কত উদাহরণ। কত চাপান–উতোর। রূপনগরে শিশুদের মৃত্যুর পর প্রথম আলোপ্রতিবেদন থেকেই আমরা জানলাম, সিলিন্ডারের গ্যাস বেলুন বিক্রি অবৈধ হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার তা নিয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তর আর পুলিশে ঠেলাঠেলি। এই ঠেলাঠেলির মধ্যেই গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আবারও ঘটে বেলুন বিস্ফোরণের ঘটনা। এরপরেও কি আমরা বলতে পারি, গ্যাস বেলুন থেকে শিশুরা নিরাপদ?

বাংলাদেশের ‘কর্তৃত্বপরায়ন’ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা সংকলন ‘সংস অব এক্সপেরিয়েন্স’–এর কবিতা সংকলনের ‘ধর্মযাজক’ আর ‘রাজাদের’ মতো। সেখানে ‘দ্য চিমনি সুইপার’ কবিতার শিশুকে আমরা বলতে শুনি, ‘অ্যান্ড বিকজ আই অ্যাম হ্যাপি অ্যান্ড ড্যান্স অ্যান্ড সিং/ দে থিংক দে হ্যাভ ডান মি নো ইনজুরি, অ্যান্ড আর গান টু প্রেইজ গড অ্যান্ড হিজ প্রিস্ট, অ্যান্ড কিং/ হু মেক আপ এ হেভেন অফ আওয়ার মিজারি’ (আর যেহেতু আমি খুশি থাকি, নাচি আর গাই/ তারা মনে করে তারা আমাকে ব্যথা দেয়নি/ আর তারা গেছে ঈশ্বর, যাজক আর রাজার প্রশংসা করতে/ যারা কিনা আমাদের দুর্দশাকে পুঁজি করে ফায়দা ওঠায়।’

কথা হচ্ছে, এভাবে আর কত মা কত বাবা তাঁদের কলিজার টুকরাদের হারালে শিশুদের জীবন ‘কর্তৃপক্ষের’ কাছে ‘পাত্তা’ পাবে? এ প্রশ্নের জবাব কি কারও কাছে আছে? এই শিশুদের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া অসহায় মানুষের কীই–বা করার কাছে আর। খ্যাতনামা ব্রিটিশ গায়ক এলটন জনের ‘টিয়ার্স ইন হেভেন’ গানটা ঘুরেফিরে শুনি। শাহিল, শায়েন, নাঈম, নূপুর বা হাসান—নিশ্চয়ই দরজার ওপাশে শান্তিতে আছে। কারণ, স্বর্গে কোনো কান্না নেই।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ইমেইল: sabiha.alam@prothomalo.com