মতামত

ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার বিএনপিকে যে বার্তা দিতে চায়

এটি কেবল একটি আসনের উপনির্বাচন ছিল। খুব ঠান্ডাভাবে কোনো আলোচনা ছাড়াই হতে পারত নির্বাচনটি, আর সব নির্বাচন যেমন হয়, হচ্ছে বাংলাদেশে। এ দেশে গত কয়েক বছরে নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়। মানুষ সেই নির্বাচনের খবরও রাখে না, জানতেও চায় না। উৎসবের নির্বাচনের এই যে পরিণতি, তার কারণ একটাই। মানুষ জানে নির্বাচন তার সময়মতোই হয়ে যাবে, সরকারি দল যাকে জেতাতে চায় সে–ই জিতবে, কেবল ভোট দেওয়ার কোনো দায় পড়বে না কারও।

কিন্তু না, একটি উপনির্বাচন সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। একজন প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার জন্য মরিয়া সরকার এমন কোনো পথ নেই, যে পথে হাঁটল না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, স্বতন্ত্র—সবাই সরকারি নির্দেশে এককাট্টা হলো, হাতে হাত রাখল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত অশীতিপর বৃদ্ধ এক নেতাকে জিতিয়ে আনতে। বলছি ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উপনির্বাচনের কথা। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত উকিল আবদুস সাত্তার প্রার্থী হয়েছেন এই নির্বাচনে। দলের সিদ্ধান্তে সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পর দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজের ছেড়ে আসা আসনে আবারও প্রার্থী হয়েছেন তিনি। এবার তাঁর পাশে আছে আওয়ামী লীগ। কেবল আছে না, খুব শক্তভাবেই আছে। শুরুতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, স্বতন্ত্রসহ বেশ কিছু প্রার্থী ছিল সেই আসনে। পরে এক এক করে সবাই সরে যেতে বাধ্য হলে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত একক প্রার্থী রইলেন উকিল আবদুস সাত্তার। ভাবগতিকে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে সাত্তার সাহেব নিজে জিততে যতটা না আগ্রহী, আওয়ামী লীগের আগ্রহ তার শতগুণ বেশি।

মনোনয়ন প্রত্যাহারের মাত্র এক দিন আগে আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থী একসঙ্গে এসে তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তাঁদের এই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। তাঁর এই উপস্থিতিই প্রমাণ করে, নিজেদের প্রার্থী সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কতটা সিরিয়াস ছিল আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে কেউ বলছেন, এত অল্প সময়ের জন্য নির্বাচিত হলেও এলাকাবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়, তাই তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ বলছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে কাজ করতে চান, আবার কেউবা অজুহাত হিসেবে সামনে এনেছেন ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক’ কারণ।

আওয়ামী লীগের এই তিন প্রার্থীর বাইরে ছিলেন আরও চারজন। জাতীয় পার্টির মনোনীত একজন, জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত নেতা একজন, জাকের পার্টির প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র একজন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের পর একে একে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন অন্যান্য প্রার্থীও। জাতীয় পার্টির দুবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি হতে পারতেন সাত্তারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু তিনিও সরে যেতে বাধ্য হন। এখানেই শেষ নয়। তিনি সাত্তারের পক্ষে প্রথম আলোকে বলেন ‘তিনি (সাত্তার ভূঁইয়া) প্রবীণ ব্যক্তি। তিনি যখন দাঁড়াইছেনই, সবাই মিলে তাঁকে পার করে দিই। সাত্তার সাব চার-পাঁচবার এমপি ছিলেন। এখন শেষ সময়। তিনি এলাকার জন্য কী করেছেন না করেছেন, সেটা বড় কথা নয়। শেষ সময় সম্মান পেয়ে যান। এটাই বড় কথা।’ একে একে সব প্রার্থী সরে যাওয়ার পর ভোটের মাঠে ছিলেন কেবল তিনজন। বিএনপির সদ্য বহিষ্কৃত নেতা আবু আসিফ আহমেদ, জাতীয় পার্টির আবদুল হামিদ ভাসানী ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম। জাতীয় পার্টির ভাসানী থাকলেও দেখা যাচ্ছে, জাপার প্রার্থীর লোকজনও এখন সাত্তারের পক্ষে কাজ করছেন।

এর মধ্যে আবু আসিফ আহমেদের পরিবার দাবি করছে, তিনি বেশ কিছুদিন যাবৎ নিখোঁজ। এর আগে নিখোঁজ হন আবু আসিফের নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারী ও তাঁর শ্যালক শাফায়েত সুমন। এ ছাড়া তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে এক সপ্তাহ আগেই রাত আড়াইটায় গ্রেপ্তার করা হয়। মুসা মিয়ার বয়স ৮০ বছর। আবু আসিফের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আবু আসিফকে ভয় দেখানো হয়েছে। তাই তিনি হয়তো ভয়েই আত্মগোপনে গেছেন। তাঁর বাড়ির সামনে–পেছনের ফটকে তালা। প্রথম আলোর রিপোর্ট বলছে, আবু আসিফ মাঠ ছাড়ার পর থেকে প্রশাসনের লোকজন নজর দিয়েছেন জাপার প্রার্থীর দিকে। পুলিশ সদস্যরা জাপার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টদের তালিকা করছেন। অর্থাৎ পুরো নির্বাচন এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে সাত্তারকে জেতানো যায়।

ক্ষমতাসীনেরা ভাবছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নিলেও কিছু ‘উকিল আবদুস সাত্তার’ এসে তাদের ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল’কে সফল করে দেবে। এতে তাদের পক্ষে দেখানো সম্ভব হবে, বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনে না এলেও বিএনপির অনেকেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার মাধ্যমে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু বিএনপিতে উকিল আবদুস সাত্তারের সংখ্যা দু–চারজনই হয়তো আছে, এর বেশি নয় কিছুতেই।

এই নির্বাচনে প্রার্থী না হয়েও আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি আমি। দেখলাম, নির্বাচনের আগপর্যন্ত এলাকায় আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। সাত্তার সাহেব নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার পর আমার নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবেই এলাকায় গিয়েছিলাম আমি। সেখানে একটা কথাই পরিষ্কার বলেছি নেতা–কর্মীদের, আর তা হলো যেহেতু এই নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই, তাই বিএনপির কর্মী, সমর্থক, ভোটারদেরও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আশুগঞ্জের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আমার সেই বৈঠকের ভিডিও গণমাধ্যমে আছে, যে কেউ চাইলে দেখে নিতে পারেন।

কথাগুলো বলছি এ কারণেই যে আমার সেই বক্তব্যকে আওয়ামী লীগ বলছে, আমি নাকি ভোট প্রতিহতের ডাক দিয়েছি এবং তারা আমাকে নির্বাচনী এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। তর্কের খাতিরে বলছি, আমি যদি জনাব সাত্তারকে প্রতিহত করার মতো কোনো কাজ করতে এলাকায় যেতামও এবং সেটা করতে গিয়ে দেশের বিদ্যমান কোনো আইন ভাঙতাম, তাহলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসন ও পুলিশ তো আছেই। আওয়ামী লীগ আমাকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার কে? এমন ঘোষণা দেওয়াটাই একটা ফৌজদারি অপরাধ, যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

অবশ্য যে ধরনের সাজানো নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাকে প্রতিহতের ডাক দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এই নির্বাচন যেকোনো মূল্যে উকিল আবদুস সাত্তারকে জেতানোর নির্বাচন। আমি নির্বাচনে কোনোভাবে অংশ না নিলেও আমার নেতা-কর্মীদের নানাভাবে হেনস্তা করছে পুলিশ। তাঁদের অনেকেই এখন ঘরছাড়া, এলাকাছাড়া।

নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে এলাকায় আমার বরাদ্দের কাজের উন্নয়নের অগ্রগতি দেখতে যেতে চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে সরাসরি বাধা দেওয়া হয় এই অজুহাতে যে আমি গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ঠিক কী কারণে আমার বরাদ্দের কাজ পরিদর্শনে গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে, সেটি অবশ্য স্পষ্ট নয়। আর পরিস্থিতির অবনতি হলে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সরকারি দল যদি কোনো অরাজকতা করে, তাহলে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্বও তাদের। কিন্তু দেশটি যেহেতু বাংলাদেশ আর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ, সুতরাং অনেক ‘উচিত’ আর ‘দায়িত্ব’ বদলে যায় মুহূর্তে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তার একটা অসাধারণ প্রদর্শনী হয়ে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উপনির্বাচনে। সরকার এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে এই বার্তাগুলো দিতে চেয়েছে—১. দল হিসেবে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে বিএনপির লোভী ও চাপের কাছে ভেঙে পড়া কিছু ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নেবেন। ২. সরকারি দল সেসব আসনে প্রার্থী দেওয়া দূরে থাক, অন্য প্রার্থীদেরও ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করার জন্য যা দরকার, তা করবে। ৩. লোভী ও দলছুট প্রার্থীরা ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সব রকম সাহায্য–সহযোগিতা পাবেন। ৪. এলাকায় বিএনপির যে নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা আছেন, তাঁদের ওপর স্টিমরোলার চালাবে পুলিশ প্রশাসন। ৫. এই সবকিছু করা হবে কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই।

বিএনপি সরকারের এসব বার্তায় কাবু হওয়ার মতো দল নয় নিশ্চয়ই। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও সরকারের সঙ্গে আপসের পথে যায়নি ‘আপসহীন’ দলটি। তাই এই সরকারের অধীনে আরেকটা কারচুপির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে, এমন আশা সরকারের করার কথা নয়। অর্থাৎ ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল’ নির্বাচনে সরকারের মূল লক্ষ্য বিএনপির অল্প কিছু নেতা, যাঁরা লোভে পড়ে যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী তাঁদের সামনে দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। তাঁদের এই বার্তা দেওয়া যে নির্বাচনে এলে সরকার যেকোনো মূল্যে তাঁদের জিতিয়ে দেবে।

ক্ষমতাসীনেরা সম্ভবত ভাবছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নিলেও কিছু ‘উকিল আবদুস সাত্তার’ এসে তাদের ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল’কে সফল করে দেবে। এতে তাদের পক্ষে দেখানো সম্ভব হবে, বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনে না এলেও বিএনপির অনেকেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার মাধ্যমে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু বিএনপিতে উকিল আবদুস সাত্তারের সংখ্যা দু–চারজনই হয়তো আছে, এর বেশি নয় কিছুতেই।

  • রুমিন ফারহানা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী