মতামত

এত বিতর্কের পর ডিসিরাই কেন রিটার্নিং কর্মকর্তা

জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে এখন সারা দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে মহা উল্লাস। ৬৪টি জেলা পরিষদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) বাদে ৬১টিতে নির্বাচন হচ্ছে।

ইতিমধ্যে ২২টি জেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন; যঁারা সবাই নৌকার প্রার্থী। এই জেলাগুলো হলো কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝালকাঠি, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, বরগুনা, বাগেরহাট, ভোলা, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ ও সিলেট। বাকি জেলাগুলোতেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর।

তারপরও প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। আওয়ামী লীগের একজন সুহৃদ দক্ষিণাঞ্চলীয় এক জেলা পরিষদ নির্বাচনী প্রচারের একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছেন। এতে ওই জেলা শহরের মেয়র বলেছেন, ‘দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিলে কেউ হাঁইট্টা যেতে পারবে না।’ প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি পৌর মেয়রকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ভিডিওর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগ করেন, দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে যা করণীয়, সেটাই করবেন।

খুবই ভালো কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ২০১৬ সালের জেলা পরিষদ নির্বাচনে ওই পৌর মেয়র ও তাঁর পুরো পরিবার দলের মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছেন। সেই নির্বাচনে তিনি যাঁকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে এনেছিলেন, তিনি এবারও বিদ্রোহী প্রার্থী। আর পৌর মেয়র যে প্রার্থীর পক্ষে এখন বিরোধীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, তিনি তাঁর পরিবারের সদস্য, ভাইয়ের স্ত্রী।

এবার পৌরসভা মেয়র যে দৃঢ়তা নিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নেমেছেন, তার চেয়ে বেশি দৃঢ়তা নিয়ে সেবার বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালিয়ে তাঁকে জিতিয়ে এনেছিলেন। আবার যিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তিনিও একসময় ছাত্রদল করতেন, পরে জাতীয় পার্টি (জেপি) হয়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন। এখানে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই। ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থই বড়।

ডিসির এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ন্যূনতম শিষ্টাচারবোধ, নৈতিকতাবোধও তাঁদের নেই। তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, সব নাগরিকের সেবক। আওয়ামী লীগের সেবক নন। ডিসি কিংবা রিটার্নিং কর্মকর্তার এ বক্তব্য এবং মোনাজাত নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন।’

জেলা পরিষদ নির্বাচনটি প্রায় একতরফা। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে এ নির্বাচন বর্জন করেছে। জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল কোথাও কোথাও প্রার্থী দিলেও টিকতে পারছে না।

জাতীয় পার্টির একজন শীর্ষ নেতা আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, তাঁরা চেয়ারম্যান দূরে থাক, কয়েকটি স্থানে সদস্যপদে প্রার্থী দিয়েও প্রচার চালাতে পারছেন না। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাধা দিচ্ছেন। ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এত কিছু করেও আওয়ামী লীগ জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে পারেনি। কোনো কোনো জেলা পরিষদে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন।

জেলা পরিষদ নির্বাচনে যে কেউ প্রার্থী হতে পারেন। কিন্তু ভোটার হবেন কেবল উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। অনেকে ঠাট্টা করে একে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন বলেও ঠাট্টা করেন।

প্রথম নির্বাচিত জেলা পরিষদগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত ১৭ এপ্রিল ৬১টি জেলা পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল বিলুপ্ত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিনের বেশি হবে না।

আমাদের স্থানীয় সরকার বা শাসনটি জগাখিচুড়ি ধরনের। একেক সংস্থার জন্য একেক নিয়ম। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে অনির্বাচিতরা প্রশাসকেরা দায়িত্বে থাকবেন কেন?

নিরুত্তাপ জেলা পরিষদ নির্বাচনের আগেই উত্তাপ এনেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান। নির্বাচন কমিশন ৬১টি জেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা ডিসিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ডিসিরা কী নির্বাচন উপহার দিয়েছেন, তা দেশবাসী দেখেছে। এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক বিতর্ক হয়েছে। বিশেষ করে ডিসিদের ভূমিকা নিয়ে। তারপরও জেলা পরিষদের মতো অপ্রত্যক্ষ ভোটে ডিসিদের নিয়ে আসতে হলো কেন? নির্বাচন কমিশনাররা নিজেরাই স্বীকার করেছেন, আস্থার সংকট আছে। জনমতের বিপরীতে গিয়ে কি তঁারা ডিসি নিয়োগ করলেন কেন? অতীতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন নিজস্ব কর্মকর্তাদেরই নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু জেলা পরিষদে কেন নয়?

সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম মনোনয়নপত্র জমা দিতে এলে ডিসি মমিনুর রহমান ওই প্রার্থীর পক্ষে মোনাজাত ও প্রকাশ্যে ভোট চেয়েছেন।

গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে তঁাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে নতুন রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন আঞ্চলিক নির্বাচনী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান। এর আগে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে মমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে যদি থাকে, তাহলে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ বলি, বিএনপি বলি, জামায়াত বলি, সবাই নিরাপদ থাকবে। আমি মনে করি, বিএনপি-জামায়াতেরও এখন দোয়া করা উচিত শেখ হাসিনা যেন আবার ক্ষমতায় আসেন।’

ডিসির এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ন্যূনতম শিষ্টাচারবোধ, নৈতিকতাবোধও তাঁদের নেই। তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, সব নাগরিকের সেবক। আওয়ামী লীগের সেবক নন। ডিসি কিংবা রিটার্নিং কর্মকর্তার এ বক্তব্য এবং মোনাজাত নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন।’

নির্বাচন কমিশন একজন আইনজীবীর নোটিশের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বা বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা বদল করেছে। কিন্তু তাঁরা সাড়ে তিন বছর ধরে জনগণের নোটিশকে উপেক্ষা করে চলেছেন।

এখনো সময় আছে। কমিশন যদি জেলা পরিষদ নির্বাচনকে (ইতিমধ্যে ২২টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী জয়ী হয়েছেন) জনগণের কাছে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য করতে চায়, তাদের উচিত হবে বাকি জেলা পরিষদ নির্বাচনেও রিটার্নিং কর্মকর্তা পদে ডিসিদের বাদ দিয়ে সেখানে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা।

কমিশনের জন্য এটি ছোট্ট পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উতরাতে না পারলে সামনে কঠিন পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া আরও কঠিন হবে।

গণতান্ত্রিক সরকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন।’ কিন্তু অন্যান্য স্থানীয় সংস্থার মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনও হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের দ্বারা, আওয়ামী লীগের জন্য নির্বাচন।

জেলা পরিষদ নির্বাচনে যঁারা ভোটার, তাঁরাও প্রায় একতরফা নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। তাহলে কি আমরা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে ফেললাম?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com