মহাত্মা গান্ধী ও রাহুল গান্ধী এক পরিবারের নন। উপরন্তু মহাত্মার মৃত্যুর প্রায় ২২ বছর পর রাহুলের জন্ম। কিন্তু একই দেশ, একই দল এবং একই প্রতিপক্ষ তাঁদের যেন একই ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। যে ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি ‘মহাত্মা’কে শারীরিকভাবে মেরেছে, ৭৪ বছর পর সেই একই বিভেদবাদের মোকাবিলায় রাহুল নামলেন দীর্ঘ পদযাত্রায়।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তাদের এই কর্মসূচিকে বলছে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’। কিন্তু রাহুল আদৌ ভারতকে ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে যুক্ত রাখতে সক্ষম কি না, সে প্রশ্নও আছে তীব্রভাবে। এ–ও ভাবছেন অনেকে, রাহুলের পদযাত্রার পরিণতিও মহাত্মার শেষ যুদ্ধের মতো নিষ্ফল হতে পারে—যখন মৃত্যুর ১৭ দিন আগে তিনি অনশনে নেমে ভারত-পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ডাক দিয়েছিলেন। এসব বিবেচনা একত্র করে রাহুলের চলতি পদযাত্রাকে ভারতে ‘গান্ধী’দের শেষ যুদ্ধও বলা যায়। তবে পদযাত্রার পথে-পথে উচ্ছ্বাস আছে। মনে হচ্ছে, ভারতের সবাই গেরুয়া বিভক্তিবাদের কাছে হার মানতে চাইছে না। কিন্তু বিভেদবাদকে পরাস্ত করার সংগ্রাম রাস্তায় হাঁটাহাঁটির চেয়েও বেশি কিছু। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ সে চাহিদা কতটা মেটাতে সক্ষম?
কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ১২ রাজ্য এবং দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলে ৩ হাজার ৫৭০ কিলোমিটার হাঁটছেন রাহুল। এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছে, তখন টিম-রাহুল কেরালায়। এখান থেকে কনটেনার-কাফেলা ঢুকবে কর্ণাটকে। প্রায় দুই শ সদস্যের মূল পদযাত্রী দল তামিলনাড়ু থেকে যাত্রা করেছে ৮ সেপ্টেম্বর। এতে আছেন প্রায় ৪০ জন নারীও। বিভিন্ন বিবেচনায় মূল দলের সদস্যদের বাছাই করেছে কংগ্রেস। প্রতিদিন তাঁরা ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার পথ হাঁটছেন। পদযাত্রা চলবে প্রায় পাঁচ মাস। যাত্রী দলের গড় বয়স ৩৮। বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য একটা দল রাহুলের পাশে এই মুহূর্তে। পথে পথে শত শত মানুষও এই নেতাদের সঙ্গ দিচ্ছেন—যে যতটা পথ পারছে। হাঁটার পাশাপাশি রাহুল ও সহযোগীরা রাজনৈতিক বিষয়ে বক্তৃতা–বিবৃতি দিচ্ছেন এবং স্থানে স্থানে সাংগঠনিক কাজও সারছেন। রাহুলের প্রত্যাশা, সব বাধা পেরিয়ে জনসংযোগ ছাড়াও দলের একদম নিচুতলার ওয়ার্ড স্তরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন যাত্রাপথে।
পদযাত্রায় প্রধান আগ্রহ ধর্মনিরপেক্ষতা হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্ব পাচ্ছে দ্রব্যমূল্য ও বেকারি। প্রথম ১৫ দিনে পদযাত্রাকালে তীব্র আবেদনময় কোনো স্লোগান পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিদিন পদযাত্রার কোনো না কোনো ছবি ভাইরাল হচ্ছে। এভাবে হয়তো আগামী পাঁচ মাস প্রচারমাধ্যমের লাগাতার নজর থাকবে রাহুলের দিকে। এই ‘পদযাত্রা’ একই সঙ্গে রাহুল ও ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। তার প্রভাব পড়বে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে।
ভারতের ইতিহাসে লংমার্চ বা পদযাত্রা বরাবরই রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে বাড়তি মনোযোগ পায়। কংগ্রেস নিশ্চয়ই এবারের পদযাত্রার ছক করতে নেমে মহাত্মার ১৯৩০-এর লবণ সত্যাগ্রহের কথাও ভেবেছে আরেকবার। সে রকম ইঙ্গিতও আছে দলটির যোগাযোগ বিভাগের প্রধান জয়রাম রমেশের কথায়। ১৬ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিনি। বললেন, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটা রূপান্তর ঘটাবে এবং কংগ্রেসকেও পুনর্জীবিত করবে তা। বিশেষ করে দলের সব প্রদেশের কর্মী-সংগঠকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক শক্তি বাড়াবে এ কর্মসূচি।
মাঠের শক্তি, রুপির শক্তি এবং ভোটের শক্তিতে বিজেপি যখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য, ঠিক এ সময় রাহুলের পদযাত্রা নৈতিকভাবে বলীয়ান করতে চাইছে দলকে। কংগ্রেসের জন্য এটা যতটা রাজনীতির প্রচারকৌশল—তার চেয়ে বেশি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। জয়রাম একে তুলনা করেছেন ‘বুস্টার ডোজে’র সঙ্গে।
ভারতজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যের পুরোনো মিত্র দলগুলোকে পাশে রাখারও মরিয়া চেষ্টা হিসেবে দেখা যায় রাহুলের লংমার্চকে। সংগত কারণেই এর প্রতি গভীর নজর রাখছে সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেস, বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তামিলনাড়ুর ডিএমকে, তেলেঙ্গানার টিআরএসসহ আরও বহু শক্তি।
পদযাত্রার মাঝেই ২২ বছর পর আগামী ১৭ অক্টোবর কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন হবে। পদযাত্রা চলাকালে প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচন নিয়ে সমালোচনাও আছে। অনেকের বিশ্বাস, সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট রাহুলের ইমেজ বাড়াতেই পদযাত্রা করা হচ্ছে। কিন্তু কংগ্রেসের ভেতর থেকে এমন আঁচ-অনুমানও মিলছে, রাহুল নন—অন্য কেউ প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। রাহুল গান্ধী সেখানে থাকবেন ‘কম্পাস’ বা ‘জিপিএস’ (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) আকারে।
ইতিমধ্যে কংগ্রেসের নতুন সভাপতি প্রার্থী হিসেবে নাম আসছে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট, কেরালার এমপি শশী থারুর এবং পাঞ্জাবের মনীশ তিওয়ারির। তবে কংগ্রেসের বহু রাজ্য শাখা এ পদে রাহুলকেই চাইছে। রাহুল নিজে অবশ্য বলছেন না, প্রায় ১৩ দশক পুরোনো দলটির প্রেসিডেন্ট পদে তিনি আবারও আসতে চান কি না। আধা গোপন এই নাটকের শেষ অধ্যায়ে কী ঘটবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। রাহুল ও তাঁর ১১৮ জনের দল যখন পদযাত্রায় হাঁটছে, তখন কংগ্রেসের বড় বড় নেতা দিল্লিতে সভাপতির বিষয় ফয়সালায় ব্যস্ত। শেষ পর্যন্ত রাহুল যদি প্রার্থী হন, তবে তিনিই মা সোনিয়া গান্ধীর জায়গায় নতুন সভাপতি হবেন এবং বিজেপি শিবির গান্ধীদের পরিবারতন্ত্র নিয়ে আরেক দফা কটুবাক্য ছোড়ার সুযোগ পাবে।
অনেক বছর ধরে কংগ্রেসের পরিচালক হিসেবে মোদি ও বিজেপিকে মোকাবিলা করছেন সোনিয়া, প্রিয়াঙ্কা, রাহুল—এই তিন ‘গান্ধী’! কিন্তু তাঁদের ঘিরে জনসমাজে গণ-আবেদন তৈরি হয়নি। ভোটের গণিতে তাঁদের হাত ধরে সফল নয় কংগ্রেস ও মিত্ররা।
অক্টোবরে যিনিই কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হন, ভয়াবহ এক রাজনৈতিক যুদ্ধ অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচন। ১৩০ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ৯৫ কোটি সম্ভাব্য ভোটারের এই নির্বাচন গণতন্ত্রের নজরকাড়া বৈশ্বিক উৎসবও বটে। ভারতের ভূরাজনৈতিক কদরও বাড়ছে। এসব বিবেচনায় রাহুলের পদযাত্রায় কেবল বিজেপি বা তার মিত্ররা নয়—বিশ্বের অন্যান্য বহু শক্তিও নজর রাখছে।
এ মুহূর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষ্যকারেরই ধারণা, বিজেপি সরকার ২০২৪-এও সহজে জিতবে। মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের খলনায়ক হিসেবে দেখানোর রাজনীতি দিয়ে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠকে এককাতারে আনতে পেরেছে তারা। ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনরেখা এখন অতি স্পষ্ট। আরএসএস প্রতিদিন ওই ভেদরেখায় জল ঢালছে। কিন্তু সমাজ তো পাল্টায়। পরিবর্তনের চেষ্টা থাকলেই পরিবর্তন আসে। রাহুল পদযাত্রার ভেতর দিয়ে ভারতীয় সমাজকে এখনকার বিপজ্জনক মোড় থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন কি না, সেটা দেখতে চায় কেউ কেউ। বুদ্ধিজীবীরা এ–ও বলছেন, ভারতজুড়ে বিভেদবাদের উত্থানকে কেবল কংগ্রেস বা ধর্মনিরপেক্ষতার সংকট নয়—বৈশ্বিক গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্যোগ হিসেবেও দেখা যায়।
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বাড়ে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে। ভারতে এখন তার ঘাটতি পড়েছে। অথচ বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১৬ ভাগ সেখানে। তা ছাড়া ভারতে ধর্মীয় জাতিবাদের উত্থান অন্যান্য দেশেও একই ধাঁচের রাজনীতিকে জ্বালানি জোগাচ্ছে। কেবল ২০২৪-এর ভারতের জন্যই নয়, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনেরও সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে। এই পদযাত্রার ফলাফলে ফয়সালা হবে কংগ্রেসের ওপর ৫২ বছর বয়সী এই ‘তরুণ’ এবং তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকা উচিত কি না?
অনেক বছর ধরে কংগ্রেসের পরিচালক হিসেবে মোদি ও বিজেপিকে মোকাবিলা করছেন সোনিয়া, প্রিয়াঙ্কা, রাহুল—এই তিন ‘গান্ধী’! কিন্তু তাঁদের ঘিরে জনসমাজে গণ-আবেদন তৈরি হয়নি। ভোটের গণিতে তাঁদের হাত ধরে সফল নয় কংগ্রেস ও মিত্ররা।
২০১৯-এর জুলাইয়ে রাহুল গান্ধী প্রকাশ্যে চার পৃষ্ঠার বিবরণ দিয়ে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এটা মোটেই লুকানো নেই, পদত্যাগ করলেও মা-বোনসহ তিনিই দলের নিয়ন্ত্রক। রাহুলই এখন গান্ধী পরিবারের মূল অস্ত্র। ভারতজুড়ে এমন ধারণাও তৈরি হওয়ার পথে—রাহুলের পক্ষে মোদিকে গদি থেকে নামানো সম্ভব নয়। সামাজিক এই মনস্তত্ত্ব কংগ্রেসে হতাশা বাড়াচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতারা রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষণে একে একে পুরোনো ঠিকানা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
ডেকান হেরাল্ড–এর ১৯ সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ৫৫৩ জন কংগ্রেস এমএলএ এবং আরও প্রায় ১৩৪ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা কংগ্রেস ছেড়েছেন। তাঁদের ২৩৩ জন এখন অন্য দলের এমপি বা এমএলএ—বিজেপিতে আছেন যার ১০৭ জন। এমন নয় যে সবাই দলের দুরবস্থায় রাহুলের প্রতি আস্থা হারিয়ে দল ছেড়েছেন—অনেককে বেশ চড়া দামে কিনছেন ক্ষমতাসীনেরা।
তবে রাহুলের ‘ভারত জোড় যাত্রা’ জনসমর্থনের ঢেউ তৈরি করতে না পারলে নীরব ভাঙনের পুরোনো প্রবাহ কংগ্রেস থেকে দলত্যাগের সুনামি তৈরি করবে। ঠিক এ কারণেই রাহুল গান্ধীর এই লড়াইকে ভারতে গান্ধীবাদের শেষ যুদ্ধ বলা হচ্ছে।
আরএসএস-বিজেপি অনেক দিন ধরে দাবি করছে, ভারতের রাজনীতিকে ‘পরিবারতন্ত্র’ থেকে মুক্ত করতে চায় তারা। তাদের এ প্রচারণার বড় লক্ষ্য ইন্দিরার নাতি-নাতনি। কিন্তু রাহুল দেখাতে চাইছেন, তিনি গান্ধী পরিবারের উত্তরাধিকার হিসেবে নয়, গান্ধীবাদের সিলসিলা আকারে লড়ছেন। বলাবাহুল্য, গান্ধীবাদের এ শেষ যুদ্ধের পরিণতি হয়তো বাংলাদেশে বসেও কিছুটা টের পাওয়া যাবে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক