মতামত

ইউক্রেন যুদ্ধ : পূর্ব ইউরোপ যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে

লাটভিয়ার স্বাধীনতা দিবসে পোল্যান্ড ও ন্যাটো সেনাদের যৌথ মহড়া
ছবি: রয়টার্স

২০২২ সাল শেষ হয়ে আসছে, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে। রুশ প্রেসিডেন্ট এখনো তাঁর ‘বিশেষ সামরিক অভিযানকে’ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে জীবন–মৃত্যুর লড়াই হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে পশ্চিমারা এটিকে নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিজেদের শক্তি নিয়োজিত করেছে।

এই যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সংঘাত হিসেবে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে একটি সহজাত সমস্যা রয়ে গেছে। এতে পরাক্রমশালী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয়দের প্রতিদিনের আত্মত্যাগ, সহ্যশক্তি ও চেতনাকে খাটো করে দেখা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়া তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে মস্কোকেন্দ্রিক একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই যুদ্ধে পূর্ব ইউরোপ পরাশক্তির ক্ষমতার লড়াইয়ে শুধু বোড়ের ভূমিকা পালন করছে না—ইউরোপের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে পোল্যান্ড এখন অনেক বেশি প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের বিশাল বোঝা শুধু নেয়নি পোল্যান্ড, নিজ দেশের ভেতর দিয়ে ইউক্রেনে অস্ত্র ও মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথও করে দিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর এ পর্যন্ত পোল্যান্ড ইউক্রেনকে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে।

২০২৩ সালের বাজেটে পোল্যান্ড প্রতিরক্ষা খাতে রেকর্ড পরিমাণ ব্যয় বৃদ্ধি করছে। আগে যেখানে প্রতিরক্ষায় জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ ব্যয় করত, দেশটি সেখানে এখন ৩ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে যা সর্বোচ্চ। এই অর্থ পোল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে ব্যবহৃত হবে। এতে পোল্যান্ডের সেনাবাহিনী মহাদেশটির অন্যতম বড় সেনাবাহিনীতে পরিণত হবে। এ ছাড়া পোল্যান্ড ট্যাংকসহ অন্য অস্ত্র কেনার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান কিনছে।

পোল্যান্ডই একমাত্র ব্যতিক্রম নয়। আগামী বছর রুমানিয়ার প্রতিরক্ষা বাজেটে বরাদ্দ জিডিপির আড়াই শতাংশে পৌঁছাবে। বাল্টিক অঞ্চলের দেশ লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়াও সামরিক ব্যয় আগামী কয়েক বছর জিডিপির আড়াই শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একসঙ্গে এখন সোভিয়েত আমলের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ছেড়ে নতুনভাবে সজ্জিত হচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ পূর্ব ইউরোপের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর মনোভাব বদলেও ভূমিকা রেখেছে। পোল্যান্ডসহ বাল্টিক দেশগুলোর রাশিয়ার প্রতি যে কর্কশ মনোভাব, সেটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অপছন্দ করত। জ্বালানি ও বাণিজ্যিক স্বার্থে জার্মানি, ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো মস্কোর প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করত। কিন্তু এ বছর ইউক্রেনে রুশ হামলায় সেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। অতিলাভজনক হওয়া সত্ত্বেও জ্বালানিসহ অন্যান্য খাতে মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

ক্রেমলিনের বসরা ইউরোপের ভূরাজনীতি নিয়ে ওয়াশিংটন, বার্লিন কিংবা প্যারিসের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও এস্তোনিয়াকে তারা বিবেচনায় রাখতে রাজি হবে না। কিন্তু দিন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে।

পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলো সামনের কাতারে থেকে মস্কোর ওপর আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি বদলাতে ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে আবার এই যুদ্ধ পূর্ব ইউরোপে পুতিনের বন্ধু হিসেবে পরিচিত দেশগুলোকেও শক্তিশালী করে তুলছে।

হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ওরবানের জন্য তো এ যুদ্ধ রীতিমতো স্বর্গ থেকে নেমে আসা সুযোগ হয়ে উঠেছে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যেখানে তলানিতে এসে নেমেছিল, সেখান থেকে নির্বাচনে জিতে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। হাঙ্গেরি সংঘাতে জড়িয়ে যাবে কি না, ভোটারদের এই ভয়কে খুব ভালোভাবেই কাজে লাগান ওরবান।

রাশিয়া থেকে বেলারুশ ও ইউক্রেন হয়ে হাঙ্গেরিতে আসা জ্বালানি তেলের একটি পাইপলাইনের ওপর ইইউর নিষেধাজ্ঞাও কৌশলে এড়াতে পেরেছেন ওরবান। ইউক্রেনের জন্য ১৯ বিলিয়ন ডলারের একটি সহায়তা প্যাকেজও আটকে দেন তিনি। রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে হাঙ্গেরি একদিকে ইউক্রেনের জন্য দেওয়া সহযোগিতা প্যাকেজ বরবাদ করে দিচ্ছে, আবার পূর্ব ইউরোপ থেকে যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্য বৃদ্ধি পায়, সেই চেষ্টাও করে যাচ্ছে। অবশ্য পোল্যান্ড, রুমানিয়াও এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ইউক্রেন ও মালদোভাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। জুন মাসে দেশ দুটি ইইউর প্রার্থীর মর্যাদা পেয়েছে।

জুলাই মাস থেকে চেক রিপাবলিকের কাছে ইইউর প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব যাওয়ার পর পশ্চিম বালকান অঞ্চলে জোটটির সম্পৃক্ততা বাড়ানোর প্রচেষ্টা বেগবান হয়েছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়া ইইউয়ের প্রার্থীর মর্যাদা পেয়েছে। ভিসা উদার করার শর্তে ২০২৪ সালের প্রথম দিকে কসাভোকেও প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়ার সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।

এর আগে ৬ ডিসেম্বর আলবেনিয়ার তিরানায় ইইউ–পশ্চিম বালকান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই অঞ্চলের প্রতি ইইউর অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ এই সম্মেলন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইইউর সদস্য নয় এমন দেশে জোটটির নেতারা সমবেত হয়েছিলেন। সম্মেলনে যৌথ বাজার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ছাড়াও জ্বালানিসংকট নিরসনে ১ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।

ক্রেমলিনের বসরা ইউরোপের ভূরাজনীতি নিয়ে ওয়াশিংটন, বার্লিন কিংবা প্যারিসের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও এস্তোনিয়াকে তারা বিবেচনায় রাখতে রাজি হবে না। কিন্তু দিন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে।

  আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • দিমিতার বেসেভ প্রভাষক, অক্সফোর্ড স্কুল অব গ্লোবাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়