শিক্ষার্থীদের কফিন মিছিলে পুলিশের বাধায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। ১৭ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষার্থীদের কফিন মিছিলে পুলিশের বাধায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। ১৭ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এ দেশের শিক্ষার্থীদের আর কত রক্ত দিতে হবে

এ দেশের ছাত্রসমাজ বৈষম্যহীন, নিরাপদ ও অধিকারের একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান আমল থেকে ত্যাগ স্বীকার করে আসছে। ১৯৫২ সালে তারা প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রক্ত দিয়েছে।

সাংবিধানিকভাবে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে, কিন্তু ৭৫ বছর পার করেও শিক্ষাসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রকৃতপক্ষে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠা হয়নি। ১৯৬২ সালে তারা শিক্ষার অধিকার রক্ষার দাবিতে রক্ত দিয়েছে, কিন্তু ৬০ বছর পার করে শিক্ষা এখন আরও বাণিজ্যিক পণ্য।

১৯৬৯ সালে তারা ১১ দফা দাবি দিয়েছে—শিক্ষার অধিকার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে, কিন্তু সেই অধিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। ১৯৭১ সালে তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং অপরিসীম আত্মত্যাগ ও অসীম সাহসী নেতৃত্বদানের মাধ্যমে একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে; কিন্তু সেই রাষ্ট্র আজ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার করেও প্রতিষ্ঠা হয়নি।

তাই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও তাদের সেই রক্তদানের অবসান ঘটেনি। স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মাথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে সাংবিধানিক অঙ্গীকার—বিশ্বের সব মানুষের ন্যায়ের সংগ্রাম সমর্থন—তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে স্বাধীন দেশের বুকে স্বদেশের পুলিশের গুলিতে তাদের রক্ত দিতে হয় ১৯৭৩ সালে। সেই থেকে চলছে।
শিক্ষার অধিকার রক্ষার দাবিতে ১৯৮৩ সালে মিলিটারি ট্যাংকের নিচে তাদের প্রাণ যায়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামরিক সরকারের জোগান দেওয়া অস্ত্রের ঝনঝনানি মোকাবিলা করে তারা ১৯৯০ সালে অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। ১০ দফা ঘোষণা করে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলে। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিজয় লাভের পর আজ প্রায় তিন দশকের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও নির্বাচিত-অনির্বাচিত কোনো রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থ দেখেনি।

এ রাজনীতির দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, ছাত্রদের আন্দোলন ও ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশের সব রাজনৈতিক অর্জন ও সংকটের সমাধান হলেও এবং তার সুফল নিয়ে তারা ক্ষমতায় যেতে পারলেও ক্ষমতায় গিয়ে সবাই কমবেশি ছাত্র ও শিক্ষাস্বার্থকে উপেক্ষা করে যায়; কিংবা পরিকল্পিতভাবে আরও পতিত করে।

উপরন্তু তাদের মধ্য থেকে যেন কোনো নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে না পারে, তারা যেন নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে বৃহত্তর স্বার্থ দেখতে না পায়, সে ব্যবস্থা করতে সব ধরনের ছাত্রসংসদ নির্বাচন ১৯৯০ সালের পর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীকে রাজনীতির নামে অন্যায্য সুবিধা পাওয়ার সুযোগ দিয়ে ও তার প্রলোভনে ফেলে তাদের দানব-দুর্বৃত্ত বানিয়ে তুলে বাকি সব শিক্ষার্থীর ওপর লেলিয়ে দিয়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতার গদি টিকিয়ে গেছে।

এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসংখ্য শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক পঙ্গুত্ব নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে। আজ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার আবাসিক হল-হোস্টেলগুলো হয়ে উঠেছে ভয়াবহ এক বিভীষিকার নাম।

এর মধ্য দিয়েও শিক্ষার্থীদের ন্যায্যতার আন্দোলন থেমে থাকেনি। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৫ সালের শিক্ষায় ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের ত্যাগ ও রক্তদান অব্যাহত আছে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ‘জাস্টিস’ চেয়েছিল। কিন্তু তাদের প্রতি ভয়াবহ অত্যাচার ও নির্যাতন চালানোর পর সড়ক নিরাপত্তা আইন করা হলেও সড়কে নিরাপত্তা এ দেশের মানুষের আজও আসেনি।

২০১৮ সালে তারা কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল। তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সহজেই তার সমাধান করা তখন সম্ভব ছিল। কিন্তু তা না করে তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সরকার অনুগত ছাত্রদের দিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন ও জুলুমের পরও আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান কোটাব্যবস্থাই বাতিল করে বিষয়টাকে জটিল করে তোলেন।

আজ ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীরা যখন সেই একই ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার করে তা স্থায়ীভাবে কার্যকর করার দাবি করেছে, তার ভয়াবহ পরিণাম আমরা দেখতে পাচ্ছি। দুই শতাধিক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। স্বাধীন দেশে ছোট্ট একটা অধিকারের আন্দোলন করতে গিয়ে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।

১৯৫২ থেকে ২০২৪—এই যে প্রায় পৌনে শতাব্দীজুড়ে শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ ও অর্জন, তা শেষ পর্যন্ত কতখানি টেকে এবং না টিকলে তার কারণ কী—প্রশ্নটা আজ খুবই প্রাসঙ্গিক। উত্তরটা সম্ভবত রয়েছে এ দেশের জাতীয় রাজনীতির চরিত্রের মধ্যে।

এ রাজনীতির দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, ছাত্রদের আন্দোলন ও ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশের সব রাজনৈতিক অর্জন ও সংকটের সমাধান হলেও এবং তার সুফল নিয়ে তারা ক্ষমতায় যেতে পারলেও ক্ষমতায় গিয়ে সবাই কমবেশি ছাত্র ও শিক্ষাস্বার্থকে উপেক্ষা করে যায়; কিংবা পরিকল্পিতভাবে আরও পতিত করে।

এই যে এ দেশের জাতীয় রাজনীতির ঐতিহাসিকভাবে সুবিধাবাদিতা, তার কুফলই ভোগ করছে এ দেশের ছাত্রসমাজ। এই রাজনীতিকে বুঝেই তাই ছাত্রসমাজকে আগামীর বাংলাদেশের করণীয় ভাবনা ভাবতে হবে।

  • রাখাল রাহা কথাসাহিত্যিক ও আহ্বায়ক, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির)
    sompadona@gmail.com