বিদ্যুৎ-সংকট এবং ‘দায়মুক্তি’ আইনের দায়

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত বলে এ রকম দায়মুক্তি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে কয়েক দিন ধরে একটি আলোচিত বিষয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট এবং এর ফলে সৃষ্ট মানুষের দুর্ভোগ। কিন্তু পরিহাস হলো, এই সংকট ও মানুষের দুর্ভোগের জন্য যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকে, তবু তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এর কারণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক একটি আইন। আইনটি হলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) আইন, ২০২১’।

২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট মোকাবিলার কথা বলে দুই বছরের জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেটা ছিল টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম আমল। এরপর চার দফায় এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ২০১২ সালে ২ বছর, ২০১৪ সালে ৪ বছর, ২০১৮ সালে ৩ বছর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ৫ বছরের জন্য আইনটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর ফলে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইনটি কার্যকর থাকার কথা।

‘আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ’ উপশিরোনামে আইনটির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ উপশিরোনামে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যেও জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’ ‘এই আইনের অধীন গৃহীত কাজের হেফাজত’ উপশিরোনামে ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি।’

আলোচিত এই অধ্যাদেশ ও আইন থেকে এটা বোঝা যায়, দায়মুক্তি কোনো সাধারণ বা নিরীহ বিষয় নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, বড় ধরনের কোনো অপরাধকে ধামাচাপা দিতে এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি না করার কৌশল হিসেবেই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ও আইন ব্যবহৃত হয়েছে।

এ আইন থেকে স্পষ্ট যে বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি আমদানি অথবা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অথবা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্য কোনো কার্যক্রম, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উপস্থাপন করা যাবে না। অভিযোগ রয়েছে, এ আইনের আওতায় বিনা দরপত্রে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয়, দফায় দফায় অতিরিক্ত মূল্যে চুক্তি নবায়ন, অতি উচ্চমূল্যের এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি, বিনা দরপত্রে গ্যাস-বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ, অবকাঠামো নির্মাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এ আইন অনুসারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংক্রান্ত কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে না। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে এ আইনকে অনেকে যুক্তিসংগতভাবেই ‘দায়মুক্তি’ আইন বলে অভিহিত করেন।

কৃত কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য সংবিধান অনুযায়ী দায়মুক্তি পেতে পারেন শুধু রাষ্ট্রপতি। তাঁর এই দায়মুক্তির মেয়াদ তিনি যত দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, সে পর্যন্তই। তবে অরডিন্যান্স জারি করে এবং সংসদে আইন পাস করে এর আগেও দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত দুটি দায়মুক্তি আইন হলো ‘ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স, ১৯৭৫’ এবং ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন ২০০৩’।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স জারি করা হয়েছিল। হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিতে সেই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ অরডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) জারি করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদ সেটি বাতিল করে এবং খুনিদের বিচারে আইনগত বাধা দূর হয়। অন্যদিকে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন ২০০৩’ পাস করা হয়েছিল। ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে পরিচালিত অভিযানকে দায়মুক্তি দিতে এ আইন পাস করা হয়। ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এ আইন বাতিল করে দেয়। এর ফলে যৌথ বাহিনীর ওই অভিযানের সময় যাঁরা হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

আলোচিত এই অধ্যাদেশ ও আইন থেকে এটা বোঝা যায়, দায়মুক্তি কোনো সাধারণ বা নিরীহ বিষয় নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, বড় ধরনের কোনো অপরাধকে ধামাচাপা দিতে এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি না করার কৌশল হিসেবেই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ও আইন ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ কারণেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে যে ‘দায়মুক্তি’ আইন করা হয়েছে, সেটি নিয়েও নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট মোকাবিলার কথা বলে যে আইন করা হয়েছিল, তা এ খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে ভুল নীতি-কৌশল অবলম্বন করা, দেশের স্বার্থের চেয়ে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া এবং নানা রকম অর্থনৈতিক দুর্নীতির যে অভিযোগ বিভিন্ন সময় উঠেছে, ‘দায়মুক্তি’ আইন সেগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে।

সরকার যদি সত্যি সত্যি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট দূর করতে চায়, তাহলে উচিত হবে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) আইন, ২০২১’ নামে ‘দায়মুক্তি’ আইনটি বাতিল করা। এরপর এ খাতের সব অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ভুল নীতি ও কৌশলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। এটা খুবই স্বাভাবিক যে অপরাধ করেও যদি বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় না থাকে, তাহলে একই ধরনের অপরাধ বারবার ঘটতে থাকবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যার সঙ্গে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জড়িত, সেখানে এ রকম দায়মুক্তি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক