নিপীড়ন ও যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
নিপীড়ন ও যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কবে মানবিক হবে

একজন আবরার, অবন্তিকা কিংবা ফুলপরীর হত্যা, আত্মহত্যা বা নির্যাতনের ঘটনা যখন প্রকাশিত হয়, তখন একই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও তৈরি হয়। ঘটনা কী ছিল? কে বা কারা এর পেছনে দায়ী? অভিযুক্ত বা অপরাধীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এ রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়, কিন্তু দরকারি একটি প্রশ্ন আড়ালেই থেকে যায়। সেটি হলো, কেন এমন অমানবিক ঘটনা ঘটেই চলেছে? এর উত্তর খুঁজে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা এড়ানো যেতে পারে।

ক্ষমতা মানুষকে কতটা আগ্রাসী করে তোলে, তার নমুনা হয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতারা। ক্ষমতার বাইরেও তাঁদের থাকে বিপুল অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ, যে কারণে সংগঠনের পদ পাওয়ার জন্য তাঁরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাই কাউকে হত্যা করতে তাঁদের দ্বিধা হন না, আর নির্যাতন করা স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয়। ধর্ষণের মতো অপরাধ করেও তাঁরা ভাবেন, শাস্তি হবে না। ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও। যে কারণে একজন শিক্ষক অন্যায়ভাবে কোনো শিক্ষার্থীর ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করেন কিংবা যৌন হয়রানি করেও মুক্তি পেয়ে যান।

বাইরে থেকে প্রায়ই অনেককে বলতে শোনা যায়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের অপরাধ বাড়িয়ে তুলছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানেন, অপরাধ বাড়তে থাকার মূল কারণ অভিযোগকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা।

অসংখ্য অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কিংবা তদন্ত কমিটি পর্যন্ত যায় না, এমনকি বিভাগীয় কমিটিতেও ওঠে না। নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীকে নানাভাবে বুঝিয়ে অভিযোগ করা থেকে নিবৃত্ত করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপস করতে তাঁকে বাধ্য করা হয়। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী-শিক্ষক কিংবা শিক্ষক-শিক্ষক পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করেন। এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি অপরাধমূলক ঘটনা প্রকাশ্য হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠেন।

কলেজের গণ্ডি পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী বুঝতে পারেন না কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাঁদের বুঝে ওঠার কোনো ব্যবস্থাও করতে পারে না। যেমন আবাসিক হলে কারা সিট পান, কীভাবে সিট পান, এর উত্তর নতুন শিক্ষার্থীদের কাছে অস্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এখানে এমন সব ঘটনা ঘটে, যার দরুন পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক ধারণা হয়। এ কাজে ছাত্রনেতাদের ভূমিকা দেখে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কেও তাঁদের বিরূপ ধারণা তৈরি হয়।

হলের আবাসনব্যবস্থার বাইরেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নানা রকম সমস্যা থাকে। পারিবারিক অসচ্ছলতাকে সামাল দিয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা চালাতে হয়। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অনটনের কথা পরিবারকে জানাতে পারেন না। জানালেও এ ক্ষেত্রে অতি দরিদ্র পরিবারের কিছু করারও থাকে না।

তা ছাড়া এই বয়সে প্রেম, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেলিং, র‌্যাগিং ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয় তাঁরা অভিভাবকদের কাছে গোপন রাখেন। ফলে নিজের মতো সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে তাঁরা প্রায়ই ভেতরে-ভেতরে ভেঙে পড়তে থাকেন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পর্যন্ত মানবিক হয়ে উঠতে পারেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায় থেকে একজন শিক্ষার্থীকে নানা রকম অন্যায় আচরণ পেতে হয়। আবার কারও কাছে তিনি এসব অন্যায়ের কথা খুলে বলতে সাহস পান না। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে একাডেমিক পরিবেশ থাকার দরকার ছিল, তা নেই।

এই অভাবই বিভিন্ন অপরাধমূলক প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য অংশগ্রহণমূলক করা সম্ভব হয়নি, বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে তাঁদের যুক্ত করা যায়নি, সহশিক্ষা কার্যক্রম থেকেও তাঁরা দূরে থাকেন। সিলেবাস শেষ হলো কি না, বড়জোর এ পর্যন্তই দৃষ্টি থেকেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

শ্রেণি কার্যক্রমে বা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও এমন কোনো কৌশল যুক্ত হয় না, যার দরুন শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে যেতে উদ্বুদ্ধ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাস ছয়েকের মধ্যে তাঁরা বুঝে যান, বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট দেয়, তবে সেই সার্টিফিকেট চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। তাই তাঁরা একাডেমিক বই রেখে চাকরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও চিন্তা করে, গাইড হাতে করে লাইব্রেরিতে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বসার আসন কীভাবে বাড়ানো যায়! অথচ একাডেমিক পড়াশোনার সুযোগ যেখানে আছে, সেখানে বই ও উপকরণের ঘাটতি নিয়ে তেমন আলোচনা করতে দেখা যায় না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোয় শিক্ষার্থীদের থাকা ও পড়াশোনার ন্যূনতম পরিবেশ নেই। এ সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করেছে। তার ওপর হলে থাকলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মিছিলে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। আবার শিক্ষকদের কাছ থেকেও শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকতে হয়, যাতে নম্বর থেকে বঞ্চিত হতে না হয়। ছাত্রনেতা ও শিক্ষকের বিরূপ আচরণের বিপরীতে একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত অসহায় বোধ করতে থাকেন।  

এর মধ্যে যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রায়ই তাঁদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। যে বয়সে একজন শিক্ষার্থীর মানসিকভাবে সবচেয়ে দৃঢ় থাকার কথা, সেই বয়সে একজন শিক্ষার্থী কেন আত্মহত্যা করেন—এ প্রশ্ন তোলা দরকার। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শেখাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। তবে শুধু কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, কোনো কোনো অপরাধ ও হয়রানি তাঁদের জীবনকে রীতিমতো দুর্বিষহ করে তোলে।  

বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমানোর জন্য সবার আগে প্রয়োজন একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণার কাজে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সিলেবাস, শ্রেণির কাজ ও পরীক্ষাপদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়মিত করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার অনুষ্ঠান যেন কেবল আনুষ্ঠানিকতায় শেষ না হয়, সেটি খেয়াল রাখা দরকার। নবীনবরণ অনুষ্ঠানেই নতুন শিক্ষার্থীদের হাতে এমন একটি নির্দেশনামূলক বই তুলে দেওয়া দরকার, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার পরিচয় থাকবে।

একই সঙ্গে এই বইয়ে সম্ভাব্য সব ধরনের অপরাধের প্রতিকারের উপায়ও লেখা থাকবে। ছাত্র-উপদেষ্টাদেরও বাড়তি প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে কীভাবে কাজ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানবিক করে তোলা সম্ভব না হলে নিপীড়ন-নির্যাতন আর হত্যা-আত্মহত্যা কমানো সম্ভব নয়।

তারিক মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।