মতামত

পাকিস্তান-বলিউড সম্পর্কের সুতা কি ছিঁড়ে গেছে?

‘পিএম নরেন্দ্র মোদি’ ছবির পোস্টারের সামনে (বাঁ থেকে ডানে) ছবির প্রযোজক সুরেশ ওবেরয়, চিত্রনাট্যকার সন্দীপ এস সিং, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, অভিনেতা বিবেক ওবেরয় এবং পরিচালক উমঙ্গ কুমার
ছবি: এএফপি

সারা বিশ্বে ভারতের হিন্দি সিনেমার তথা বলিউডের ছবির কোটি কোটি অনুরাগী দর্শক আছেন। তাঁদের মধ্যে আমার মতো বহু পাকিস্তানিও আছেন। কিন্তু পাকিস্তানি দর্শকদের সেই প্রেমে এখন তিক্ততা ঢুকে গেছে। ১৯৪০-এর দশকের শেষ থেকে আশির দশকের পুরোটা সময় বলিউডের স্বর্ণযুগ ধরা হয়।

১৯৬০ ও ’৭০-এর দশকে আইকনিক ছবি মুঘল-ই-আজমগঙ্গা-যমুনার মতো নতুন ধারা সৃষ্টি করা সিনেমা তৈরি হয়েছিল। কালা পাথর, জাঞ্জিরদিওয়ার-এর মতো সিনেমাগুলোয় অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অসাম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তরুণ প্রজন্মের অনুসরণীয় চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন।

তারপর ছিল মান্ডির মতো রাজনৈতিক ব্যঙ্গধর্মী ছবি, যেখানে যৌনকর্মীদের নিগৃহীত জীবনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বলিউডের সিনেমাগুলোর কাহিনি ও নির্মাণশৈলীতে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আমি খেয়াল করছি, বলিউডের ছবিগুলোর গল্প ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে।

যে বলিউডে একসময় ওমর আকবর অ্যান্টনির মতো ধর্মীয় সহনশীলতাকে উদ্‌যাপন করা ক্ল্যাসিক নির্মিত হতো (যেখানে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী তিনটি নায়ক চরিত্র ছিল), সেই মূলধারার বলিউড এখন প্রায়ই বিজেপি এবং দলটির ভারত-সম্পর্কিত ধারণার মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বলিউডে এখন প্রায় মৃত। এখনকার বলিউডের গড় ভাষ্যটি সোজা কথায়—ভারত হলো হিন্দুদের দেশ এবং এখানে যে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী এসেছেন, তাঁরা হিন্দুদের মাতৃভূমির ক্ষতির জন্য দায়ী।

ভারতের ক্ষমতাসীনদের এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে এবং বলিউডে প্রতিফলিত হচ্ছে। যেসব নির্মাতা এই পেশিশক্তিওয়ালা উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দু ভারতের আখ্যানকে সমর্থন করছেন না, তাঁরা বিজেপির সমর্থক শিবির থেকে ভয়ংকর আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। অভিনেতা আমির খান ও শাহরুখ খান ২০১৫ সালে ভারতে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তারপর থেকে তাঁদের সিনেমা বর্জন করার জন্য নিয়মিত আহ্বান জানানো হচ্ছে।

বলিউডের বর্তমান ছবিগুলোয় হয় কোনো মুসলমান চরিত্র থাকছে না, নয়তো মুসলিম চরিত্র রাখা হলেও সেগুলোকে খল হিসেবে কিংবা পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে বলিউডের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এই বিষাক্ত বায়ু ছড়িয়ে দেওয়ার উত্সাহী চিয়ারলিডার হয়ে উঠেছেন।

অনুপম খের, কঙ্গনা রনৌত ও অক্ষয় কুমারের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিজেপি সরকারের শীর্ষস্থানীয় সমর্থক হিসেবে রয়েছেন। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জীবন নিয়ে নির্মিত পিএম নরেন্দ্র মোদি ছবিটি মুক্তি পায়। বিবেক ওবেরয় অভিনীত ছবিটি যে বিজেপির প্রচারমূলক ছবি ছিল, সে বিষয়ে খুব কমই রাখঢাক করা হয়েছে এবং ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল সেই বছর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে।

কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানিরা বলিউডের সিনেমা দেখার সময় কোনো রাজনৈতিক পার্থক্য মাথায় আনেনি। একটা আন্তরিক উষ্ণতা তারা অনুভব করেছে। বলিউডের ভাষা ও সংস্কৃতি—কোনোটিকেই তাদের কাছে ভিনদেশি বা এলিয়েন গোছের কিছু মনে হয়নি। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধার পর এবং প্রায়-স্থায়ী উত্তেজনা বিরাজ করার পরও তাদের মনোভঙ্গিতে পরিবর্তন আসেনি। দুঃখজনকভাবে, ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান সেই সুদিনকে অপূরণীয়ভাবে শেষ করে দিয়েছে।

অন্য তারকাদেরও মোদির সঙ্গে সেলফি তুলতে ও তাঁকে আলিঙ্গন করতে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। এমনকি দীর্ঘকাল ধরে বলিউডে আধিপত্য বিস্তার করা তিন ‘খান’-আমির, সালমান ও শাহরুখকেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুপ থাকতে হয়েছে। তাঁরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন—কথা বলতে গেলে মাশুল দিতে হবে। একই সঙ্গে পাকিস্তানি অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও বলিউডে কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া রাইস ছবিতে শাহরুখের বিপরীতে মাহিরা খান অভিনয় করেছিলেন। এই ছবি ছিল পাকিস্তানের হলে দর্শকদের দেখতে দেওয়া শেষ বড় বলিউড সিনেমা। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সিনেমাগুলো ভারতে মুক্তি পেতে বাধার মুখে পড়েছে।

এ ছাড়া বলিউডে ভাষাগত সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। আগের প্রজন্মের সিনেমার শিরোনাম হিন্দি, ইংরেজি ও উর্দু হরফে নিয়মিত লেখা থাকত। ছবির সংলাপ ও গানের কথায় উর্দু শব্দের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। কারণ, উর্দু পাকিস্তানের পাশাপাশি উত্তর ভারতেও জনপ্রিয়। এখন ছবিতে উর্দুর ব্যবহার একেবারে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় নিহত মানুষের স্বজনদের জীবন নিয়ে বানানো ছবি ফিরাক ২০০৮ সালে মুক্তি পায়।

ওই সময় মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গুজরাট দাঙ্গায় মোদির প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগপর্যন্ত তা বহাল ছিল। কিন্তু ফিরাক-এর মতো ছবি এখন ভারতের সেন্সর বোর্ড মুক্তির অনুমতি দেবে—এটি এখন কেউ কল্পনাও করতে পারে না। উল্টো এখন ইসলামবিদ্বেষকে উসকে দেওয়া ছবি ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সরকারি সমর্থনে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।

সাম্প্রতিক পুনরুজ্জীবনের আগে পাকিস্তানের চলচ্চিত্রশিল্প সাম্প্রতিক পুনরুজ্জীবিত হওয়ার একটি দীর্ঘ সময় ধরে পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রশিল্পের সেই নিষ্ফলা সময়ের কারণে বলিউডের প্রতি পাকিস্তানিরা গভীর টান অনুভব করেছিল। সেই টান ছিল একাধিক প্রজন্ম ধরে।

কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানিরা বলিউডের সিনেমা দেখার সময় কোনো রাজনৈতিক পার্থক্য মাথায় আনেনি। একটা আন্তরিক উষ্ণতা তারা অনুভব করেছে। বলিউডের ভাষা ও সংস্কৃতি—কোনোটিকেই তাদের কাছে ভিনদেশি বা এলিয়েন গোছের কিছু মনে হয়নি। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধার পর এবং প্রায়-স্থায়ী উত্তেজনা বিরাজ করার পরও তাদের মনোভঙ্গিতে পরিবর্তন আসেনি। দুঃখজনকভাবে, ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান সেই সুদিনকে অপূরণীয়ভাবে শেষ করে দিয়েছে।

  • আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • সালমান জাফর কানাডায় বসবাসরত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত লেখক ও চলচ্চিত্র িবশ্লেষক