ভলোদিমির জেলেনস্কি একটি ভুলে যাওয়া যুদ্ধে একজন বিস্মৃত যোদ্ধা। রাশিয়া যখন ইউক্রেনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য আগ্রাসনের দুই বছর পূর্তি করতে চলেছে, তখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট খসে পড়া তারার মতো তাঁর উচ্চতা ও ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলেছেন।
দুই বছর পুরোনো যুদ্ধটা এখন কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া স্থবির যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ইউক্রেনীয়দের অনন্য ‘আক্রমণ অভিযান’ থমকে গেছে এবং প্রতিশ্রুত ‘বিরাট সাফল্য অর্জন’-এর ব্যাপারটা এখন একগুঁয়ে ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে। ‘ইট মারার বদলে পাটকেল খাওয়ার’ বিষয়টি দুঃখজনকভাবে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হয়ে গেছে।
ক্ষোভের জায়গা দখল করে নিয়েছে নির্লিপ্ততা। যা-ই হোক, এ যুদ্ধের এখনকার যে গতিপ্রকৃতি তা থেকে বলা যায়, ‘বিজয়’ অনেক অনেক দূরের বিষয়।
মনে হচ্ছে, বিশ্ব ইউক্রেন নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আরও খারাপ করে বললে, বিশ্ব এখন বিরক্ত। সে কারণে যেসব কলাম লেখক জেলেনস্কির সাহস ও ইউক্রেনের জনতার প্রতিরোধকে একসময় ধর্মোপদেশ বিলোনোর মতো করে নিয়মিতভাবে তাঁদের লেখায় তুলে ধরতেন, তাঁরা এখন অবলীলায় তাঁদের আগের অবস্থান ত্যাগ করেছেন।
আমন্ত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে অথবা পার্লামেন্টে বক্তৃতা দেওয়ার সময় চিরচেনা সবুজ সোয়েটার গায়ে দেওয়া জেলেনস্কিকে দেখে মনে হচ্ছে, নির্বোধ কিংবা অপ্রচলিত যোদ্ধা ও মুক্তিসংগ্রামী। ইউক্রেনের ‘বীর’ জনতার ‘ন্যায়’-এ যুদ্ধের প্রতি সংহতি জানিয়ে জনসাধারণের প্রতিবাদ সমাবেশও অনেক মাস আগে বন্ধ হয়ে গেছে। ইউক্রেন এখন আর সংবাদমাধ্যমের জরুরি ও সহানুভূতিজাগানিয়া ‘সংবাদ’ নয়।
ইউক্রেনের নিয়তি হচ্ছে, তাদের প্রতি বিশ্বের যে মনোযোগ ছিল, এখন তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে এই দুর্ভাগ্যজনক নিয়তি দেখতে পাচ্ছি। যে কাপুরুষ শক্তি ফিলিস্তিনিদের পরিত্যাগ করেছে, সেই একই শক্তি ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করবে।
জেলেনস্কি আর ইউক্রেন নিয়ে এখন একমাত্র ‘খবর’ হচ্ছে, হোয়াইট হাউস থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়া অস্বস্তিকর খবর। জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল পলিটিকো খোঁচা মেরে শিরোনাম করেছে, ‘ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁস হওয়া কৌশলনীতি বলছে, দুর্নীতি এখন সেখানকার সত্যিকারের হুমকি’।
এই সংবাদের শিরোনামের শব্দগুলো একই সঙ্গে ভয়ানক ও অমার্জিত। এটি আমেরিকানদের, নির্দিষ্ট করে বলতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাহসী ইউক্রেনীয়দের প্রতি যে অটুট ভালোবাসা ছিল, তা যে কমতে শুরু করেছে, তারই লক্ষণ।
পলিটিকো সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে ‘বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইউক্রেনের দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে যতটা বলছেন, তার থেকেও অনেক বেশি উদ্বিগ্ন।...এই দুর্নীতি রাশিয়ার বিরুদ্ধে চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে পশ্চিমা মিত্রদের সরে যাওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে এবং কিয়েভ দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ নিতে পারছে না।’
এটা জেলেনস্কির জন্য বিপদ, বড় বিপদ।
আমি ধারণা করি, তিনি জানেন যে সেই সময় ও পরিস্থিতি আসছে, যখন মিত্ররা তাঁর পাশে থাকবে না। ওয়াশিংটন ও ইউরোপের মিত্রদের ‘লৌহদৃঢ় ইচ্ছা’ ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে মরে যাচ্ছে।
ইচ্ছা পুরোপুরি উবে গেলে অনিবার্যভাবে অর্থের জোগানও শূন্যে নেমে আসবে।
ভ্লাদিমির পুতিনকে থামিয়ে রাখতে এবং তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা আটকে রাখতে হলে জেলেনস্কির প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এরই মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। আশঙ্কা থাকছে যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এত দিন ধরে ইউক্রেনের অর্থ জোগানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছিল, সেটা অব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা কম। আন্তমহাদেশীয় কোষাগার খুব দ্রুতই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা এর মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আইনপ্রণেতাদের কাছে ইউক্রেনের জন্য নগদ সহযোগিতা ভিক্ষা করেছেন। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই আত্মবিশ্বাসী কিংবা ভরসা জাগানোর মতো আবেদন নয়। হোয়াইট হাউসের ব্যবস্থাপনা ও বাজেট কার্যালয়ের পরিচালক বলেছেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে কংগ্রেসের পদক্ষেপ ছাড়া এ বছরের শেষ নাগাদ ইউক্রেনের জন্য আরও অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মজুত থেকে সরঞ্জাম দেওয়ার মতো অর্থ থাকবে না। এ মুহূর্তের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যে তহবিল প্রয়োজন, তার জন্য জাদুকরের পাত্র আমাদের কেউ দেবে না। আমাদের অর্থ ফুরিয়ে আসছে এবং সময়ও প্রায় ফুরিয়ে আসছে।’
এই আতঙ্ক উদ্রেককারী চালের পরও ইউক্রেনের জন্য সময়মতো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকান আইনপ্রণেতাদের মধ্যে যুদ্ধে অর্থ জোগান দেওয়ার এই অনীহা ইউক্রেন যুদ্ধে শীতকালের কাদার মধ্যে ঠেলে ফেলবে। যুদ্ধের একটা মৃত পরিসমাপ্তি ঘটবে।
কথার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সংকল্প এখন পর্যন্ত অটুট। সম্প্রতি ব্রাসেলসে কূটনৈতিকদের একটি জমায়েতে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা কিছুতেই পিছু হটব না।’ দিমিত্রি কুলেবা বলেছেন, ‘আমরা আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাব, আমরা আমাদের লড়াই জারি রাখব। ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করবে না। এটা শুধুই ইউক্রেনের নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়। এটা ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয়।’
দিমিত্রি কুলেবার এই বক্তব্য অন্যদের মধ্যে আবেগ সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে। সবার মধ্যে আবেগ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর এই আহ্বান অনেকটা ভাঙা রেকর্ডের মতো শুনিয়েছে।
দিগন্তে বড় আরেকটি ভয় উঁকি দিতে শুরু করেছে। জেলেনস্কির চিন্তা ও পরিকল্পনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারী ও অমঙ্গলে আলবাট্রস পাখির বোঝার মতো ঝুলে রয়েছেন। আজ থেকে এক বছর পর ওভাল অফিসে পুতিনের পোষা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের অর্থ হচ্ছে, হঠাৎ করেই অনেক কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া। ইউক্রেনের যুদ্ধ ও জেলেনস্কির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সবকিছুই ইতি ঘটতে পারে।
এর মধ্যে আরেকটি যুদ্ধে বেশির ভাগ সমর্থন চলে যাওয়ায় জেলেনস্কির প্রতি সমর্থনটা ফিকে হয়ে আসছে। আমার মনে হয়, জেলেনস্কি নিজেও সেটা বুঝতে পারছেন। জেলেনস্কি ভালো করেই বুঝতে পারেন যে তিনি এতটা ক্ষমতাহীন যে ইউক্রেনকে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা কিংবা শেষের পাতার সংবাদ হয়ে ওঠার বিষয়টি ঘুরিয়ে দিতে পারবেন না।
ইউক্রেনের নিয়তি হচ্ছে, তাদের প্রতি বিশ্বের যে মনোযোগ ছিল, এখন তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে এই দুর্ভাগ্যজনক নিয়তি দেখতে পাচ্ছি। যে কাপুরুষ শক্তি ফিলিস্তিনিদের পরিত্যাগ করেছে, সেই একই শক্তি ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করবে।
ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজেও সেটা জানেন।
আন্দ্রে মিত্রোভিকা টরন্টোভিত্তিক কলাম লেখক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত