মতামত

বিএনপি কেন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে বা যাবে না

ধরুন, আপনি এমন একটি ঘরে আছেন, যা অন্ধকার এবং সেখানে একটি সাপ আছে। পরিস্থিতিটা কেমন? যেহেতু আপনি দেখতে পারছেন না, তাই বোঝার উপায় নেই সাপটি কোথায়। তাই বলা হয়, অন্ধকার ঘরে একটি সাপ মানে সারা ঘরেই সাপ। অনুমান করা ছাড়া আপনার সামনে কোনো পথ নেই।

জাতীয় নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে। এক বছরও হাতে নেই। বিভিন্ন আলোচনায় শোনা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা ১৮ সালের মতো হবে না। তাহলে কেমন হবে আগামী নির্বাচন? কেউই তা জানে বলে মনে হয় না। এর চেয়ে মূল্যবান প্রশ্ন, এই নির্বাচনে বিএনপি যাবে তো? রাজনীতি নিয়ে যাঁরা পড়ে থাকেন বা ‘বিশ্লেষণ’ করেন, তাঁদের কাছ থেকেও এর কোনো ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জবাব এখনো আমরা শুনিনি। বোঝা যায় নির্বাচন নিয়ে আমরা, মানে জনগণ পুরো অন্ধকারে আছে। এ নিয়ে তাই এখন শুধু নানা অনুমানই করা সম্ভব, এর বাইরে কিছু নয়।

আসুন, আমরা আগামী নির্বাচন নিয়ে নিজেরাই নিজেদের কিছু প্রশ্ন করি এবং এর কিছু অনুমাননির্ভর জবাব বের করার চেষ্টা করি। আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। কারণ, সংবিধানে এর বাইরে কিছু নেই। রাজনৈতিকভাবেও আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবির প্রতি কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। আবার আওয়ামী লীগই মনে করে, এই নির্বাচনে বিএনপিকে লাগবে।

বিএনপি না গেলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এই সূত্রে আমাদের কিছু প্রশ্ন; আওয়ামী লীগ কি শেষ পর্যন্ত তাদের অধীনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে? বা থাকতে পারবে? সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে তারা কীভাবে নির্বাচনে নেবে?
এসব প্রশ্ন তোলা থাক। আরও কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা ও প্রশ্ন বের করে নিই, অনুমাননির্ভর উত্তরগুলো পরে খোঁজা যাবে।

নির্বাচন কি তাহলে আওয়ামী লীগের অধীনই হবে? আমাদের অনুমান কী বলে? এর কোনো ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জবাব নেই। এটা নির্ভর করবে বিএনপির দম কতটা আছে, তার ওপর। অথবা বিএনপির আন্দোলনের শক্তির ওপর। আর বিদেশিরা এখানে কতটা কী করতে পারবে, সেটাও সম্ভবত নির্ভর করবে এর ওপরই। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও দলগুলোর শক্তি-সামর্থ্যের হিসাব-নিকাশের বাইরে তাঁদের ভূমিকা রাখার আসলে কোনো সুযোগ নেই।

বিএনপি অনেক দিন ধরেই বলে আসছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। গতকাল রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বিএনপির নেতারা। সেখানে তাঁরা আবারও তাঁদের একই অবস্থান স্পষ্ট করেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু বলেন, ‘অবশ্যই এই সরকারের অধীন বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। সেটা আমরা খোলাখুলিভাবে বলেছি। বিশ্বের যারা বাংলাদেশের ওপর নিবিড়ভাবে কাজ করছে, পর্যবেক্ষণ করছে, সবার কাছে এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে বর্তমান দখলদার, অনির্বাচিত সরকারের অধীন বাংলাদেশের জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি, তাদের সরকার, তাদের সংসদ নির্বাচিত করতে পারবে না।’

গত রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বিএনপির নেতারা।

বিএনপির এই অবস্থান সামাল দিতে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু দিন ধরেই নানা মহলে ও নানাভাবে সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দেওয়া শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আওয়ামী লীগও বসেছিল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তাঁদের বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, অবাধ হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনকে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। তিনি আরও বলেছেন, ইইউ চায় বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নিক।

দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতারা কূটনীতিক বা রাজনীতিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের ওপর জোর দিচ্ছে। এই সূত্রেও কিছু প্রশ্ন তোলা যায়; এই সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাসে বিএনপি কেন আস্থা রাখবে? ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিএনপির যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে তারা কেন আওয়ামী লীগের অধীন নির্বাচনে যাবে? আর এই যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিদেশিদের কাছে নানাভাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে, তারা আগামী নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলতে পারবে? বা আদৌ তাঁরা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে কি?

আসুন, এবার শুরু থেকে প্রশ্নগুলোর অনুমাননির্ভর উত্তর খোঁজা শুরু করি। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হয় আওয়ামী লীগ তাদের অধীন নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়েই এগোবে। কোনো ছাড় না দেওয়ার নীতিই হবে তাদের কৌশল। আর একই সঙ্গে বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’ আশ্বাস দিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র কাজে লাগিয়ে দলটিকে বোঝানোর কৌশল নেবে। সম্মানজনক বা নির্দিষ্টসংখ্যক আসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমঝোতার উদ্যোগও থাকবে। এভাবেই সফল হতে চাইবে আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়ার এসব কৌশল সফল না হলে ভিন্ন পথ ধরতে পারে আওয়ামী লীগ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপনির্বাচন এ ক্ষেত্রে একটি জুতসই মডেল হতে পারে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে অনুমাননির্ভর লেখালেখিও হয়েছে। নির্বাচনের ‘উকিল মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই কৌশলের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী বিএনপির কিছু নেতাকে নির্বাচনে এনে বিজয়ী করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বক্তব্য আমরা এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে পারি। তিনি বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও দলটির ‘অনেক নেতা’ অংশ নেবেন এবং তাঁদের ‘ঠেকানো যাবে না’। আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত এই পথ ধরলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

এসব নানা কৌশলের কোনো একটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন এবং সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে যত সহজে নানা কিছু অনুমান করা গেল, সেসব কাজ কি আওয়ামী লীগ তত সহজেই করতে পারবে? তা না-ও হতে পারে। বিএনপির গত ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা সমাবেশ, একটি কথিত ডেডলাইন ও সমাবেশের আগে দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে বিভক্তি, কোনো কোনো নেতার সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কানাঘুষা শোনা গেলেও বাস্তবতা হচ্ছে, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিতে ভাঙন ধরানো সম্ভব হয়নি। এই পর্যায়ে এসে দল ভাঙার দায়িত্ব কোনো নেতা নেবেন কি না, সেটাও এক বড় প্রশ্ন।

আর সাধারণ যুক্তি বলে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে আশ্বাস আওয়ামী লীগের তরফে দেওয়া হচ্ছে, বিএনপির তাতে আস্থা রাখার কোনো কারণ নেই। কারণ, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দলটির হয়েছে। একমাত্র বাধ্য হলেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কখন তারা ‘বাধ্য’ হবে? উত্তর হতে পারে; দলটি যদি তাদের দাবির পক্ষে কার্যকর জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে রাজপথে একেবারে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে পারে অথবা বিএনপিতে যদি ভাঙনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নির্বাচনে না গিয়ে তখন দলটির সামনে হয়তো কোনো পথ থাকবে না।

নির্বাচন কি তাহলে আওয়ামী লীগের অধীনই হবে? আমাদের অনুমান কী বলে? এর কোনো ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জবাব নেই। এটা নির্ভর করবে বিএনপির দম কতটা আছে, তার ওপর। অথবা বিএনপির আন্দোলনের শক্তির ওপর। আর বিদেশিরা এখানে কতটা কী করতে পারবে, সেটাও সম্ভবত নির্ভর করবে এর ওপরই। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও দলগুলোর শক্তি-সামর্থ্যের হিসাব-নিকাশের বাইরে তাঁদের ভূমিকা রাখার আসলে কোনো সুযোগ নেই।

তারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী কোনো পক্ষকে চাপ দেবে অথবা বোঝানোর চেষ্টা করবে। তারা চাইলেই কাউকে ক্ষমতায় বসাতে বা কাউকে হটাতে পারে না। বিদেশিদের দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়েছে ঠিকই কিন্তু যারা শুধু এর ওপর ভরসা করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তাঁদের জন্য মনে হয় হতাশাই অপেক্ষা করছে।

নির্বাচন নিয়ে যেহেতু আমরা অন্ধকারে আছি, তাই এ নিয়ে নানা অনুমান করা ছাড়া আমাদের আসলে কীই বা করার আছে!

  • এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
    akmzakaria@gmail.com