৭ জুলাই একটি শোচনীয় ঘটনা ঘটে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে। সামান্য বিষয় নিয়ে সেখানকার রাজবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজার ওপর চড়াও হন রাজশাহী-১–এর সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, কিলঘুষি এবং হকিস্টিক দিয়ে প্রায় মিনিট ১৫ বেধড়ক পিটিয়ে শিক্ষককে গুরুতর জখম করেন তিনি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁর চিকিৎসক অভিযোগটি সমর্থন করলেও আক্রান্ত শিক্ষক কোনো মামলা করার সাহস পাননি। এমনকি গতকাল ১৪ জুলাই ওমর ফারুকের বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওমর ফারুক তাঁকে প্রহার করেননি এবং ‘নিজেদের ধাক্কাধাক্কির কারণে আহত হয়ে’ তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন বলে দাবি করেন সেলিম রেজা। অন্যদিকে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি, রাজশাহীর সভাপতি বলেছেন, ওমর ফারুকের কাছে মার খাওয়ার খবর সেলিম রেজা নিজে তাঁকে বলেছিলেন এবং এখন তাঁর ভয়ে তিনি তা অস্বীকার করছেন।
৭ জুলাই ঘটনার মাত্র সপ্তাহখানেক আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক আসমা সিদ্দীকা হেনস্তার শিকার হন একজন ছাত্রের কাছে। সাধারণ ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে অভিযুক্ত ছাত্রকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সাম্প্রতিক কালে শিক্ষক লাঞ্ছনার আরও নির্মম কয়েকটি ঘটনা ঘটে। গাজীপুরে হকিস্টিক দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে।
তার কিছুদিন আগে নড়াইলে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে পুলিশের উপস্থিতিতে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানোর হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। এর আগে মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে চরম অবমাননার শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়। এ ঘটনাগুলোয় সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। শাহবাগ প্রেসক্লাবসহ সারা দেশে বিভিন্ন সমাবেশ হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জনমনের চাপে গ্রেপ্তার হয় এবং নড়াইলের ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মৃদু হলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
ওপরের ঘটনাগুলো খুব সাম্প্রতিক। এ ঘটনাগুলোর শিকার হয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকেরা, বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষকেরা। কিন্তু অন্য বহু কিছুর মতো শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাগুলোও অনেকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার–বিবেচনা করছেন। কেউ এ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে শিক্ষকেরা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন শুধু ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে, কেউ বিচার দাবি করছেন শুধু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি বিচার করে।
এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। যেকোনো সমাজে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বেশি ঝুঁকিতে থাকে, বেশি নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় তাদের। এ জন্য আমরা বিভিন্ন মানবাধিকার দলিল ও অনেক সংবিধানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আলাদাভাবে জোর দিতে দেখি। কিন্তু তার মানে এটি নয় যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নটি কম গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সংবিধান ও ফৌজদারি আইনব্যবস্থা যেকোনো ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও বৈষম্য নিষিদ্ধ, ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ একইভাবে দণ্ডনীয়।
শিক্ষক লাঞ্ছনার কোনো কোনো ঘটনায় আমরা শিক্ষকের সাম্প্রদায়িক পরিচয় নিয়ে যতটা কথা বলছি, আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরছি না সেভাবে। লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটলে, শিক্ষকেরা বা অন্য যে কেউ খুন-জখমের শিকার হলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে ফৌজদারি আইনে এর বিচার হতে হবে। এখানে অপরাধকর্মটি গুরুত্বপূর্ণ, অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পরিচয়টি প্রশ্নটি সব ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয়ও নয়। যেমন নড়াইলের ঘটনায় সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিদ্বেষ ছিল, কিন্তু গাজীপুরে উৎপল কুমার সরকার নিহত হওয়ার ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতা ছিল না।
সেখানে অভিযুক্ত ছেলেটির নিজের স্বীকারোক্তি অনুসারেই, তার হীন অপকর্মের শাসন করাতে ক্ষুব্ধ হয়েই সে উৎপল কুমার সরকারকে বেধড়ক মারধর করে হত্যা করে।
এমন আরও ঘটনা ঘটতে পারে, যেখানে সংখ্যালঘুরা আক্রমণের শিকার হয় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে নয়, সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে গুন্ডাতন্ত্র বা গ্যাং কালচারের আধিপত্যের জন্য, বিচারহীনতার কারণে বা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। সব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক ঘটনা হিসেবে দেখলে আসল সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো আড়ালে পড়ে যায়, সমাজে গুরুতর অপরাধবৃত্তির আসল কারণগুলো ঢাকা পড়ে যায়। শুধু ভিকটিমের সম্প্রদায়গত পরিচয়ের বিবেচনায় বিচার দাবি করলে, অন্য সম্প্রদায়ের ভিকটিমের জন্য সুবিচার দাবিটিও উপেক্ষিত হতে পারে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী একটি প্রতিবাদলিপি দিয়েছে ১৩ জুলাই। তারা এতে শিক্ষক লাঞ্ছনার বেশ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরে ‘এ ধরনের ঘটনার প্রায় প্রতিটির সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বা প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম–বাণিজ্য এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে’ বলে দাবি করেছে। হতে পারে, এ ধরনের ঘটনায় গুরুতর অপরাধকর্মকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক অনুভূতিকে ব্যবহার করা হয়। আমরাও অনেকে তখন লাঞ্ছনার শিকার ব্যক্তিটির ধর্মীয় পরিচয়টি দেখি, পেছনের কারণ দেখি না।
শিক্ষক লাঞ্ছনার বিষয়টি তাই শুধু সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় না দেখাই শ্রেয়। এখানে সমাজে বিরাজমান নানা অপশক্তি, তাদের পেছনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতির বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
আমার মনে পড়ে নারায়ণগঞ্জে বছর পাঁচেক আগে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের লাঞ্ছনার ঘটনাটি। সে ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করার অভিযোগে তাঁকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছিল। এ জন্য অভিযুক্ত ক্ষমতাশালী ওসমান পরিবারের সদস্য সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খ্যাতনামা বহু মানুষ নিজেরা কান ধরে ওঠবস করানোর ছবি আপলোড করে শিক্ষকের প্রতি সমবেদনা ও সেলিম ওসমানের বিচার দাবি করেছিল। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত উঠেছিল এবং সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের প্রতিবাদস্পৃহা হারিয়ে যাওয়ার পর এ ঘটনায় সেলিম ওসমান সব ধরনের তদন্তের বিবেচনায় নির্দোষ ‘প্রমাণিত’ হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরে ঘুষ নেওয়ার মামলায় শ্যামল কান্তি ভক্তকে জেলে যেতে হয়েছিল। এই মামলা সাজানো কি না, আমরা কেউ তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করিনি, গোটা ঘটনাবলির পেছনে সারা দেশে স্কুল-কলেজ কমিটি, সেখানে নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা যে অরাজকতা তৈরি করে রাখেন সে রকম কিছু ছিল কি না, তা জানার চেষ্টা করিনি।
তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সরকার নিজে এসব সংসদ সদস্যকে প্রশ্রয় দেয় কি না, এ নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন তোলার সুযোগও খুঁজিনি। এসব হলে হয়তো শ্যামল কান্তিদের মতো আরও শিক্ষককে নানা রকম হেনস্তার শিকার হতে হতো না।
শিক্ষক লাঞ্ছনার বিষয়টি তাই শুধু সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় না দেখাই শ্রেয়। এখানে সমাজে বিরাজমান নানা অপশক্তি, তাদের পেছনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতির বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন সারা দেশে ছাত্রলীগের কোটি কোটি টাকার নিয়োগ–বাণিজ্যের একটি বিস্তারিত রিপোর্ট কিছুদিন আগে দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্ট অনুসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্রলীগের কমিটিগুলো গঠন করা হয় নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা ও নিয়মিত বখরা প্রদানের নিশ্চয়তার বিনিময়ে। এত গুরুতর একটি অভিযোগের পর দুদক, উচ্চ আদালত, সংসদ কোথাও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, আমরা সবাই প্রায় নির্বিকারভাবে বিষয়টি মেনে নিয়েছি। এই চাঁদাবাজি বা বখরার প্রতিবাদ করলে ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে যেকোনো শিক্ষকই লাঞ্ছনার শিকার হবেন, আমরা কি তা অস্বীকার করতে পারি? অতীতে আরও সামান্য কারণে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি খ্যাতিমান শিক্ষক দম্পতিকে আমরা ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেখেছি।
শিক্ষক লাঞ্ছনার কিছু ঘটনার পেছনে অবশ্য শুধু ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়গুলো থাকে। এ অনুভূতি ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলের যেকোনো ধর্মের মানুষের মধ্যে তীব্র। আমাদের পরিচিত একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ও আমার বিভাগের একজন শিক্ষক সাম্প্রতিক কালে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন, আদালতে মামলার মুখেও পড়েছেন। তাঁরা দুজনই প্রগতিশীল ও উদার চিন্তার মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত। কিন্তু অন্য অনেকের মতো তাঁরাও হয়তো মানুষের মধ্যে ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা কত গভীরে, তা পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।
সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সব সম্প্রদায়ের এই স্পর্শকাতরতাকে ঢালাওভাবে অযৌক্তিক ভাবাটাও সম্ভবত ঠিক নয়। ব্রিটিশরা আমাদের জন্য দেড় শ বছর আগে ধর্মীয় অপরাধের আইন করে গেছে। সেখানে যেকোনো ধর্মের মানুষের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করার মতো বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর কিছু না পারি, আমরা সবাই এসব থেকে বিরত থাকতে পারি। ঢালাওভাবে সব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে আখ্যায়িত না করে বরং ফৌজদারি দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধকর্মটির বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকতে পারি। একই সঙ্গে সমাজে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সার্বিক সংকটের বিষয়ে সচেতন হতে পারি। সমাজে উসকানি ও বিভিন্ন ধরনের লাঞ্ছনা কিছুটা হলেও কমতে পারে তাহলে।
● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক