মতামত

বাংলাদেশের ব্রিকসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক না রাজনৈতিক?

পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়টি বেশ তড়িঘড়ি করেই এগিয়ে গেল। অবশ্য এর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্রিকস দেশগুলোর গঠন করা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (এনডিবি) যোগ দিয়েছে।

১৪ জুন জেনেভায় দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষিণ আফ্রিকা বর্তমানে ব্রিকসের নেতৃত্বে রয়েছে। সেই বৈঠকের পরই কার্যত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য হওয়ার আগ্রহের কথা শোনা যায়। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাংলাদেশ সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদনও করে ফেলেছে। বাংলাদেশের সবকিছুর ব্যাপারেই এখন চীনের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। এই জোটের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই সদস্যদেশ এরই মধ্যে বলে দিয়েছে, ব্রিকসে বাংলাদেশকে স্বাগত জানানো হবে।

বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেওয়ার বিষয়ে এরই মধ্যে অর্থনীতি ও পররাষ্ট্র বিশ্লেষকদের কিছু প্রতিক্রিয়া পত্রপত্রিকায় পাওয়া গেছে। সাধারণভাবে ব্রিকসে বাংলাদেশের যুক্ততাকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে তড়িঘড়ি কোনো ফল পাওয়া হয়তো যাবে না, কিন্তু ব্রিকসে যুক্ত হলে সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরালো করার একটি সুযোগ তৈরি হবে।

তা ছাড়া ব্রিকসের সদস্য হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের দাম ও মর্যাদা বাড়তে পারে। ব্রিকসের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা আছে। অনেক পরিকল্পনার কথাও শোনা যায়। ব্রিকসের সম্প্রসারণ ও সামনের দিনগুলোয় এই জোট কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তার ওপর বাংলাদেশে এই জোট থেকে কী পেতে পারে, এর অনেক কিছুই নির্ভর করবে।

আর কূটনৈতিকভাবে দেখলে একে পররাষ্ট্রনীতির বহুমুখী যুক্ততা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ, এই জোট বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ নিয়ে গঠিত। যেখানে চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ রয়েছে। এই জোটে জায়গা পাওয়া মানে এই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নামও উচ্চারিত হবে। এ বছরের মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পানডোর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্রিকস গ্রুপের প্রতি বিশ্বজুড়ে আগ্রহ ‘ব্যাপক’। এই আগ্রহী দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর মতো দেশগুলো রয়েছে। ব্রিকস যদি বাংলাদেশের আবেদন গ্রহণ করে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব যে বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ব্রিকসের বর্তমান পাঁচ সদস্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে দেশগুলো বৈচিত্র্যময়। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেই বিভিন্ন ধারার এই দেশগুলোর যুক্ততা ও এর ফলাফল নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ব্রিকস একটি বাস্তবতা এবং এ পর্যন্ত যে অগ্রগতি, তাতে তারা পশ্চিমা-নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ করার দিকে এগোচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।

আমরা এখন জানি, এ অঞ্চলের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের গুরুত্বকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সে কারণেই বাংলাদেশ এখন অনেকটা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আমরা চাই বা না চাই, এটাই বাস্তবতা। এমন একটি সংবেদনশীল ও জটিল পরিস্থিতিতে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হবে কীভাবে? সমস্যা হচ্ছে, দেশের স্বার্থ ও ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ (ক্ষমতা ধরে রাখা) সব সময় এক বিন্দুতে না–ও মিলতে পারে।

নিউজউইক-এ এক লেখায় ফরেন পলিসির বিশ্লেষক ও নিউজউইক-এর ডেপুটি এডিটর টম ও’কন্নর (চায়না অ্যান্ড রাশিয়াস গ্রোয়িং ব্রিকস ব্লক স্পিডস ডিক্লাইন অব ইউএস ইনফ্লুয়েন্স) লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ‘গ্লোবাল সাউথ’-এ নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার সংগ্রাম করছে, তখন ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে ব্রিকস আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সদস্যপদের জন্য নতুন নতুন আবেদন পাচ্ছে। এটা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সংকেত দিচ্ছে।

শুরু থেকেই এটা পরিষ্কার যে ব্রিকস ‘গ্লোবাল নর্থ’-এর পাল্টা হিসেবে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও অগ্রসর দেশগুলোর সংগঠন জি-৭-এর বিকল্প মডেল হিসেবে দাঁড়াতে চাইছে। বৈশ্বিক জিডিপি বিবেচনায় নিলে ব্রিকস দেশগুলো সম্মিলিতভাবে জি-৭-কে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালে ব্রিকসের বৈশ্বিক জিডিপি ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ধারণা করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপির ৫০ ভাগ ব্রিকসের দখলে থাকবে।

অর্থনীতিবিদ ফিলিপ পিলকিংটন মনে করেন, (দ্য নিউ ব্রিকস অ্যালায়েন্স ইজ আ মোরাল থ্রেট টু দ্য ওয়েস্ট) নিজস্ব বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা চালু করার যে উদ্যোগের কথা ব্রিকসের তরফে শোনা যায়, তা সফল হলে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের জন্য তা প্রকৃত হুমকি হিসেবেই হাজির হবে। সামনে ব্রিকসের আওতা যদি বাড়ে এবং নতুন কিছু দেশ যুক্ত হলে এ আশঙ্কা আরও বাড়বে।

ব্রিকস একটি অর্থনৈতিক জোট, কিন্তু বিশ্বরাজনীতিতে এর একটি সুস্পষ্ট অবস্থান ও পক্ষপাত আছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। এই ইস্যুতে সদস্যদেশগুলো ‘পশ্চিমের’ সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এই পাঁচ দেশের কোনোটিই রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় অংশ নেয়নি; বরং এই সময়ে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য বেড়েছে।

‘কূটনৈতিকভাবে ইউক্রেন যুদ্ধপূর্ব-সমর্থিত রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের বিভক্তির একটি স্পষ্ট রেখা উন্মোচিত করেছে’—এ মন্তব্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাথুউ বিশপের। গত বছর ইকোনমিক অবজারভেটরিতে তিনি লিখেছেন, সেই বিবেচনায় কিছু ইউরোপীয় ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে ব্রিকস সম্ভবত উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর একটি ক্লাবে পরিণত হওয়ার চেয়ে বরং রাজনৈতিক ক্লাবে পরিণত হতে যাচ্ছে। এই দেশগুলোর কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদ তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে তুলে ধরে।

জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের (এসডব্লিউপি) উপপরিচালক গুন্টার মাইহোল্ড মনে করেন, ব্রিকস দেশগুলো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার অবস্থানে রয়েছে। তাঁর ধারণা, এই দ্বিমেরুর বিশ্বে দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো নিজেদের অবস্থান ভালো করার চেষ্টায় আছে। অন্যদিকে, চীন এই প্ল্যাটফর্মকে তার বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ব্যবহার করছে।

ব্রিকস দেশগুলোর ‘কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদ’ ও চীনের ‘বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা’—এ দুই নিয়ে পশ্চিমের উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। ব্রিকসকে পশ্চিমা বিশ্ব সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে দেখে; বিশেষ করে এই জোটে চীন ও রাশিয়ার যুক্ততার কারণে। ব্রিকসে যোগ দেওয়া অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে কতটা সুফল দেবে, সেই হিসাব-নিকাশ এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু এর রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে কিছু ধারণা ও হিসাব-নিকাশ সম্ভব।

আমরা এখন জানি, এ অঞ্চলের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের গুরুত্বকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সে কারণেই বাংলাদেশ এখন অনেকটা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আমরা চাই বা না চাই, এটাই বাস্তবতা। এমন একটি সংবেদনশীল ও জটিল পরিস্থিতিতে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হবে কীভাবে? সমস্যা হচ্ছে, দেশের স্বার্থ ও ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ (ক্ষমতা ধরে রাখা) সব সময় এক বিন্দুতে না–ও মিলতে পারে।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে, তা ক্ষমতাসীনদের পছন্দ হয়নি স্বাভাবিক কারণেই।

এ নিয়ে সরকারি দলের লোকজন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় সোচ্চার। অন্যদিকে, চীন খোলাখুলিভাবেই সরকারের প্রতি তার সমর্থন ঘোষণা করেছে। এখন সরকার যদি নিজ দলের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে, তাহলে বিপদ আছে।

বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে চীন স্বাগত জানিয়েছে। আর এ সিদ্ধান্ত যে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোর পছন্দ হবে না, তা বুঝতে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার দরকার নেই। এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বাংলাদেশ কি ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

এই রাজনৈতিক বিবেচনার যে অর্থনৈতিক ঝুঁকি আছে, তা উপেক্ষা করার সুযোগ আছে কি? আমাদের বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেই সূত্রে যে অর্থনৈতিক প্রাপ্তি, তার সবচেয়ে বড় অংশ আসে তো যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে। ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশকে কী দেবে আর কী নিয়ে নিতে পারে—সেই হিসাবটি খুবই জরুরি।

  • এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

    ই–মেইল: akmzakaria@gmail.com