জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশি এখন দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল সফর করছেন। শনিবার থেকে শুরু হওয়া পাঁচ দিনের সফরে ভিন্ন যে দুই গন্তব্যে তিনি যাচ্ছেন তা হলো সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং কুক আইল্যান্ড। দুটি দেশই হচ্ছে ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র, জনসংখ্যার হিসাবও সেখানে একেবারেই সামান্য। ১৫টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত কুক আইল্যান্ডে ২০ হাজারের সামান্য বেশি সংখ্যক মানুষের বসবাস। অন্যদিকে আয়তনে কিছুটা বড় সলোমন দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা হচ্ছে সাত লাখের একটু বেশি। ভূখণ্ড গত বিস্তৃতির দিক থেকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের আছে ছয়টি প্রধান দ্বীপ ছাড়াও ৯০০ টির বেশি ক্ষুদ্র দ্বীপ।
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের প্রভাব বলয়ে থাকা দেশ দুটি ইদানীং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজের পথ বেছে নেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করার পর থেকে কীভাবে এদের সেই পথ থেকে সরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে বলা যায় আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর ঘুম যেন হারাম হয়ে গেছে। এটা এ কারণে আরও বেশি হচ্ছে যে চীন সেখানে ধীরে হলেও নিজস্ব পদ চিহ্ন রাখতে শুরু করেছে। ফলে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে সেরকম অবস্থান থেকে দেখা যেতে পারে, কেননা জাপানও হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা মৈত্রী বজায় রাখার বাইরে বৃহত্তর বলয়ে সেই অঞ্চলের প্রভাবশালী একটি দেশ।
ফলে ধারণা করা যায় যে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এর বাইরে ওশেনিয়া অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত একটি সামরিক বলয় গড়ে নিয়ে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ভাবেই ধরে নিয়েছে। আর এ কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা যে কোনো দেশের সেই অঞ্চলে উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের সন্দেহ এবং ঘৃণা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়, চীনকে ঘিরে পশ্চিমের যে প্রবণতা আমরা এখন লক্ষ্য করছি। বর্তমান বিশ্বের মুকুট হীন স্বঘোষিত মহারাজের এই যুদ্ধ ক্ষুধার কল্যাণে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল তাই অন্য দিকে অজান্তেই হয়ে উঠছে বিধ্বংসী সব সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের বিশাল এক মজুত, যুদ্ধ খেলার মৃত্যু ফাঁদে যা কিনা আটকে ফেলছে পুরো সেই অঞ্চলকে।
চীনের সেখানে উপস্থিত হওয়াকে জাপান তাই নিজের জন্য কিছুটা হলেও বিব্রতকর হিসাবে দেখছে। অনেকটা যেন এ কারণেই সলোমন দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছাবার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হায়াশি দেশটি নিয়ে জাপানের উদ্বেগ খোলামেলাভাবেই প্রকাশ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সলোমন দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করা অবস্থায় জাপানের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে গত বছর চীনের সঙ্গে দেশটির স্বাক্ষরিত নিরাপত্তা চুক্তির ওপর ঘনিষ্ঠ নজর জাপান রাখছে এবং টোকিও আশঙ্কা করছে সেই ভূখণ্ডে চীনের সামরিক উপস্থিতির সুযোগ চুক্তি করে দিতে পারে।
জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলোমন রাজধানী হোনিয়ারায় সলোমন দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রী মানাসসে সোগাভারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে টোকিওর সেই উদ্বেগ সম্পর্কে পরোক্ষ ইঙ্গিত প্রদানের মধ্যে দিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে দ্বীপ দেশটি কীভাবে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সোগাভেরা অবশ্য উত্তরে উল্লেখ করেন যে অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন। এর আগে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমিয়া মানেলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সমুদ্র নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রগুলোতে সহায়তা প্রদানে জাপানের প্রস্তুত থাকার উল্লেখ হায়াশি করেছেন।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশগুলোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের উদ্বেগের শুরু চীনের সেই অঞ্চলে উপস্থিত হওয়ার পর থেকে। অঞ্চলের দেশগুলোর অধিকাংশই এর আগে তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে চলছিল। তবে গত এক দশকে চীন সেখানে কিছুটা আগ্রাসী কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এদের অনেককেই নিজ দলে ভিড়িয়ে নিলে তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এরা ছিন্ন করতে শুরু করে।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জ যেমন ২০১৯ সালে চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে নিয়ে এবং তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে আগের অবস্থান বদল করে নিয়েছে। গত বছর এপ্রিল মাসে চীনের সঙ্গে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের স্বাক্ষরিত নিরাপত্তা চুক্তি হচ্ছে সেই ধারাবাহিকতার অংশ, অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে পশ্চিমের জোটের মধ্যে দেখা দেওয়া সন্দেহ যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এদের আবারও দলছুট করে নিয়ে নিজের কাতারে নিয়ে আসার নানারকম পাঁয়তারাও তাই অঞ্চল জুড়ে ইতিমধ্যে এরা শুরু করে দিয়েছে এবং জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিস্তারিত বিষয়াবলি প্রকাশ না করা হলেও পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছে যে ফাঁস হয়ে যাওয়া কিছু তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে চীন পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করতে পারে। বেইজিং এবং হোনিয়ারা উভয়েই অবশ্য সেরকম সম্ভাবনাকে ভিত্তিহীন বলে বাতিল করে দিয়েছে। চুক্তিতে চীনের জাহাজের দ্বীপ রাষ্ট্রের বন্দরে নোঙর করার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি অবশ্য কোনো পক্ষ থেকেই অস্বীকার করা হয়নি এবং পশ্চিম এটাকেই চীনের সামরিক উপস্থিতির পথ করে দেওয়ার প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরছে।
প্রশ্ন হচ্ছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে কেন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের এই উদ্বেগ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে অঞ্চল জুড়ে পশ্চিমের দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সামরিক উপস্থিতির দিকে মনে হয় দৃষ্টি ফেরানো দরকার।
বিশ্ব মানচিত্রের নিচের দিকে চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় এন্টারটিকার ওপরে বিশাল এক অঞ্চল জুড়ে শক্ত যে সব সামরিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র গড়ে নিয়েছে তার বিস্তৃতি ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ থেকে শুরু করে পূর্ব দিক বরাবর অস্ট্রেলিয়া হয়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ রাষ্ট্র জুড়ে বিস্তৃত। ওয়াশিংটন বিশাল সেই অঞ্চলকে দৃশ্যত নিজের খাস তালুক হিসাবে গণ্য করে এবং অন্য কারও সেখানে প্রবেশ মার্কিন প্রশাসন কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে নারাজ। বিস্তৃত সেই একচ্ছত্র সমর বলয় থেকে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে রাখার দীর্ঘ মেয়াদি মার্কিন পরিকল্পনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। স্নায়ু যুদ্ধের দিনগুলোতে দিয়েগো গার্সিয়ার নিয়ন্ত্রণ ব্রিটেনের হাত থেকে গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে এর সূচনা হয়েছিল, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তি সোভিয়েত হুমকি অপসারিত করলেও মার্কিন শাসক গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে শত্রুর শেষ এর মধ্যে দিয়ে হয়নি; বরং নতুন শত্রুর আবির্ভাব পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তুলেছে।
দিয়েগো গার্সিয়া এক সময় ছিল ভারত মহাসাগরের ব্রিটিশ উপনিবেশ মরিশাসের অংশ এবং চাগোস দ্বীপমালা নামে পরিচিত সেই এলাকায় মানব বসতিও অনেক আগে থেকেই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে ব্রিটেন মরিশাসের স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নেওয়ার আগে দিয়েগো গার্সিয়াকে মরিশাসের বাইরের অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করে এবং সেখানকার আদি অধিবাসীদের মরিশাসে সরিয়ে নেয়, যেখান থেকে নিজ ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার অধিকার থেকে আজও যাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। দিয়েগো গার্সিয়া এখন হচ্ছে কেবলই সামরিক দ্বীপ, বেসামরিক লোকজনের প্রবেশ যেখানে একেবারেই নিষিদ্ধ।
দিয়েগো গার্সিয়া থেকে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর অগ্রসর হলে প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপ এবং গুয়াম ছাড়াও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ও অস্ট্রেলিয়াতেও আছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক উপস্থিতি। গুয়াম দ্বীপের ৩০ শতাংশের কাছাকাছি ভূমি মার্কিন সামরিক বাহিনীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের আরেকটি দেশ পালাউ দেশের ভূখণ্ডে একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও রাডার স্থাপনা গড়ে নিতে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। মাইক্রোনেশিয়া ফেডারেল রাষ্ট্রও যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা করছে। পাপুয়া নিউ গিনিও দেশের একটি নৌ ঘাঁটির আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কাজ করছে।
এসব কিছুর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে অকাস সামরিক জোট গঠন করে। পরমাণু শক্তি চালিত ডুবোজাহাজ সংগ্রহে জোট অস্ট্রেলিয়াকে সাহায্য করে আসছে। এ ছাড়া চীনের ক্রম বর্ধমান হুমকি সামাল দিতে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতকে নিয়ে কোয়াড জোট যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেছে। এর বাইরে আরও আছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নজরদারির একটি সামরিক জোট বিগ আই। ফলে ধারণা করা যায় যে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এর বাইরে ওশেনিয়া অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত একটি সামরিক বলয় গড়ে নিয়ে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ভাবেই ধরে নিয়েছে। আর এ কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা যে কোনো দেশের সেই অঞ্চলে উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের সন্দেহ এবং ঘৃণা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়, চীনকে ঘিরে পশ্চিমের যে প্রবণতা আমরা এখন লক্ষ্য করছি। বর্তমান বিশ্বের মুকুট হীন স্বঘোষিত মহারাজের এই যুদ্ধ ক্ষুধার কল্যাণে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল তাই অন্য দিকে অজান্তেই হয়ে উঠছে বিধ্বংসী সব সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের বিশাল এক মজুত, যুদ্ধ খেলার মৃত্যু ফাঁদে যা কিনা আটকে ফেলছে পুরো সেই অঞ্চলকে।
মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক