গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সামনে প্রকৃতপক্ষে শত ফুল ফোটার একটা সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, শহীদ মিনার, রবীন্দ্রসরোবর, শিল্পকলা, আর্ট গ্যালারি, শাহবাগ, প্রেসক্লাবসহ ঢাকার জনপরিসরগুলো নানা চিন্তা ও মতের সম্মিলন ও মিথস্ক্রিয়া ঘটে চলেছে।
সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের নতুন নতুন চিন্তা নিয়ে মিলনায়তনগুলোতে প্রতিদিনই তরুণ ও প্রবীণ চিন্তাবিদেরা নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। অর্থনীতি কিংবা দর্শনের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়ের ওপর আলোচনাতেও উপচে পড়েছে দর্শক-শ্রোতায়। প্রত্যেকেই নিজের মতো করেই সবকিছু জেনেবুঝে ও যাচাই করে নিতে চাইছেন, প্রত্যেকেই চাইছেন নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের অংশীজন হয়ে উঠতে।
ঢাকার জনপরিসরগুলোতে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের যে উচ্ছ্বাস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের যে কর্মযজ্ঞ, সেটাই পুরো সমাজের চিত্র নয়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এখন প্রধান দুটি উদ্বেগের বিষয় হলো জিনিসপত্রের দাম আর নিরাপত্তা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যেসব জন–আকাঙ্ক্ষা সামনে নিয়ে এসেছে, তার অন্যতম ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান। কেউ অপরাধ করলে আদালতের মাধ্যমে তাঁর বিচার হতে হবে। কিন্তু জনতার বিচারের নামে পিটিয়ে হত্যা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নির্যাতনে মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানে হরেদরে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ও ব্যর্থতাও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। কেননা ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের বিকেল থেকেই বঞ্চিত রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীরা দখল শুরু করেন। পরিবহন সমিতি থেকে শুরু করে ঘাট, জলমহাল, হাটবাজার—সব জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজন পালিয়ে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, অর্পিত দায়িত্বজ্ঞানেই তা পূরণে তাঁরা নেমে পড়েন। কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যে সংঘাতেও তাঁরা জড়ান। বিএনপির কেন্দ্র থেকে একের পর এক বহিষ্কার করেও এই দখলবাজির সংস্কৃতি তারা ঠেকাতে পারেনি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে পুলিশের যে নিষ্ঠুর ও বেপরোয়া ভূমিকা, এর কারণে ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক জায়গায় থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ আক্রান্ত হয়েছিল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, তারা নৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। বিগত সরকারের সুবিধাভোগী পুলিশের অনেক সদস্য কাজেও যোগ দেননি। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে জনগণকে আগলে রাখার ক্ষেত্রে ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর যে জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার ছিল, সেটা করতে অনেকটাই তারা ব্যর্থ হয়। আদালতে যখন রাজনৈতিক আসামিদের তোলা হয়েছে, সে সময় তাঁদের ওপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। এ কাজে জড়িত ছিলেন রাজনৈতিক দলের আইনজীবীরা। শুরুর দিকে মব জাস্টিস উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতে আসামিদের ওপর হামলার ঘটনা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
‘মব জাস্টিস’ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, গত কয়েক দিন আমরা তার বেশ কয়েকটা ঘটনা দেখেছি। যেখানে–সেখানে যাঁর যেমন ইচ্ছা লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে নেমে পড়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে মাজার ভাঙার মতো ঘটনা ঘটেছে।
মব জাস্টিস শেষ পর্যন্ত ‘মব লিঞ্চিংয়ের’ মতো হৃদয়বিদারক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। রাজশাহীতে পা হারানো সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, মাত্র তিন দিন আগে সন্তানের বাবা হয়েছিলেন তিনি। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শওকত আলী দিদারকে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে আটকে রেখে এক ব্যক্তিতে চোর সন্দেহে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হামলার শিকার হয়ে সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা নিহত হয়েছেন। এ হত্যার প্রতিবাদে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছেন।
কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো থেমে নেই। গাইবান্ধা ও ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর আওয়ামী লীগের দুজন ও বিএনপি একজন মারা গেছেন। স্বজনদের অভিযোগ, অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের কারণে তাঁরা মারা গেছেন। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে অনিশ্চিত হলেও তাঁদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল বলে জানিয়েছেন। যদিও পুলিশ দাবি করেছে, তাঁদের কোনো অসুস্থতা ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যেসব জন–আকাঙ্ক্ষা সামনে নিয়ে এসেছে, তার অন্যতম ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান। কেউ অপরাধ করলে আদালতের মাধ্যমে তাঁর বিচার হতে হবে। কিন্তু জনতার বিচারের নামে পিটিয়ে হত্যা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নির্যাতনে মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।
কয়েক দিন আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি ও লুটের ঘটনা বেড়েছে। যমুনা টেলিভিশনের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, রাত বাড়লেই অশান্ত হয়ে উঠছে ঢাকা। আধিপত্য বিস্তার কিংবা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে তুচ্ছ ঘটনায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন পক্ষ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় অনেক থানা-ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে। কারাগার ভেঙে অনেক কয়েদি বের হয়ে গেছেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও আছেন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বড় ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক আ ন ম মুনীরুজ্জামান। প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি দ্রুত পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে। এ জন্য বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রথমেই পুলিশের বর্তমান অবস্থার ওপর একটা সমীক্ষা করা প্রয়োজন। এর ওপর ভিত্তি করে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের দিকে যেতে হবে। শুরুতেই পুলিশ আইন পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করতে হবে।
বাংলাদেশে ৫৩ বছর ধরে প্রতিটি সরকার পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগের সময়ে সেটা চূড়ান্ত মাত্রা পেয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ পুলিশকে তাদের দলীয় বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিল। রাষ্ট্র সংস্কার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের যে উদ্যোগ চলছে, তাতে দীর্ঘ মেয়াদে সাধারণ মানুষই উপকৃত হবে। কিন্তু এটাও বড় শঙ্কার বিষয় যে দীর্ঘ দিন যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থাকে, তাহলে তার সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। খেয়েপরে নিরাপদে বাস করতে পারছেন কি না, তাঁদের কাছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চিং অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। নাগরিকদের মানবাধিকারের মৌলিক প্রশ্নের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী