সৌদি আরব একটি জাতীয়তাবাদী রূপান্তরের পথে হাঁটছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর দেশটির এ বছরের জাতীয় দিবসে সারা দেশের মানুষ; বিশেষ করে সৌদি জনসাধারণের মধ্যকার সংখ্যাগুরু তরুণেরা রাজপথে জাতীয় পতাকা ওড়াতে ওড়াতে গাড়ি চালিয়ে উল্লাস করেছেন। তঁারা সৌদির সামরিক মহড়ায় দলে দলে যোগ দিয়ে আনন্দে মেতেছেন।
সৌদির কার্যত নির্বাহী প্রধান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগে, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দেশাত্মবোধ চেতনার উন্মেষ ঘটছে, তার পেছনে মূলত দেশটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্দীপনা কাজ করছে।
সৌদি আরব তার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে। চীনের মধ্যস্থতায় ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করতে রাজি হওয়ার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনার সূত্রপাত করার মধ্য দিয়ে রিয়াদ উদীয়মান প্রধান অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের সদস্য হয়েছে। এ ছাড়া ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধেও সক্রিয় হয়েছে সৌদি সরকার।
দেশের ভেতরের সংস্কারমূলক কাজের অংশ হিসেবে রাজপরিবারের হাতে, বিশেষ করে মোহাম্মদ বিন সালমানের হাতে সব ক্ষমতা কার্যকরভাবে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভিন্নমতাবলম্বীদের, বিশেষ করে বিকল্প রাজনৈতিক মডেল চালুর পক্ষে প্রচার চালানো ইসলামপন্থীদের কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সৌদি সরকারের ভাষ্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সরকার সৌদির ইতিহাস পুনর্লিখনে মনোযোগী হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের পাঠ্যক্রমেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক খেলাধুলায়ও (বিশেষ করে গলফ ও ফুটবল) বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা তেল উৎপাদন নীতি গ্রহণ করছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার কার্যক্রমের মূল বিষয় হলো সৌদি আরবকে একচেটিয়াভাবে তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বের করে এনে সেটিকে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থনীতির ধারায় নিয়ে আসা। এই লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে কয়েকটি কথিত ‘গিগা প্রজেক্ট’ চালু করেছে। উদাহরণ হিসেবে লোহিত সাগরের কাছে বিশাল ব্যয়ে নির্মিতব্য কার্বন নিরপেক্ষ শহর নিওম-এর কথা বলা যেতে পারে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের অধীন সৌদি আরবকে এমন একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা তার অর্থনীতির বিকাশ ও বৈচিত্র্যের জন্য নিজস্ব সম্পদ বিনিয়োগ করতে চায়। এ ছাড়া সৌদি সরকার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপের কিছু প্রধান শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাব বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোহাম্মদ বিন সালমান সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে।
এসব উন্নয়নের মর্মকথা বুঝতে হলে মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৬ সাল থেকে প্রকাশ্যে যেসব কথা বলে আসছেন, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। তিনি বলে আসছেন, তাঁর পূর্বসূরিরা ব্যর্থ নীতি অনুসরণ করে এসেছেন এবং এমনভাবে দেশ শাসন করে এসেছেন, যা দেশটির জাতীয় স্বার্থকে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। তিনি বলেছেন, সৌদি রাজপরিবার এর আগে ইসলামকে যেভাবে চর্চা করেছেন, বিশেষত অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় বিরোধী গোষ্ঠীর তৎপরতায় যেসব প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের কারণে সৃষ্ট হুমকিকে যেভাবে মোকাবিলা করেছে, তা ভুল ছিল।
মোহাম্মদ বিন সালমান বিশ্বাস করেন, সৌদি আরবকে টিকিয়ে রাখতে হলে ধর্মের ওপর নির্ভর না করে বরং জাতীয়তাবাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া মোহাম্মদ বিন সালমান মনে করেন, সীমাহীন দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা সৌদির স্থিতিশীলতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে খর্ব করেছে।
সৌদি আরবের পূর্ববর্তী সরকারগুলো দেশকে তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে সরিয়ে আনার বিষয়ে যে অনীহা দেখিয়েছে, তাকে মোহাম্মদ বিন সালমান অমার্জনীয় হিসেবে মনে করে থাকেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অনেক দেরি হওয়ার আগেই সৌদিকে এই ঐতিহাসিক ভুলগুলো শোধরাতে হবে।
যেহেতু সৌদি সরকারের অর্থনৈতিক প্রকল্পের সাফল্য সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করছে, সেহেতু মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও পররাষ্ট্রনীতির অ্যাজেন্ডাকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করছেন। তিনি সৌদি আরবকে একটি নেতৃস্থানীয় ভূরাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চান। তিনি তাঁর দেশকে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার বাণিজ্য, পরিবহন, রসদ ও যোগাযোগের মূল অনুঘটক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান।
মোহাম্মদ বিন সালমানের অধীন সৌদি আরবকে এমন একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা তার অর্থনীতির বিকাশ ও বৈচিত্র্যের জন্য নিজস্ব সম্পদ বিনিয়োগ করতে চায়। এ ছাড়া সৌদি সরকার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপের কিছু প্রধান শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাব বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোহাম্মদ বিন সালমান সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
● বার্নার্ড হেইকেল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক। তিনি সৌদি আরবের আধুনিক ইতিহাসের ওপর একটি বই লিখছেন