সিটি নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি যাবে না

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘যেতে পারি/যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি/ কিন্তু, কেন যাবো?

সিটি নির্বাচনে বিএনপির যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়টি এত সরল নয়। রাজনীতি মানেই কৌশল-অপকৌশলের খেলা। এই খেলায় কখন কে হারবে, কে জিতবে, বলা কঠিন।
আবার সাময়িক হার অনেক সময় ভবিষ্যৎ জয়ের পটভূমি তৈরি করে। এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। বিএনপি সেই নির্বাচন বর্জন করে। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, বিএনপি রাজনীতির মূলধারার বাইরে চলে গেছে। কিন্তু দলটি সেই নির্বাচনে না যাওয়ার ‘লভ্যাংশ’ তুলে নেয় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। আবার ২০০৭ সালে জোর করে নির্বাচন করতে গিয়ে সবকিছু গুবলেট করে ফেলে।

নির্বাচন কমিশন প্রথমে জানিয়েছিল, পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে সেপ্টেম্বরে। পরে তারা সেটি নিয়ে এল মে-জুনে। দুই ঈদের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন। একদিকে প্রচণ্ড গরম থাকবে, অন্যদিকে ঝড়বৃষ্টিরও আশঙ্কা আছে। নির্বাচন কিংবা আন্দোলন কোনোটির জন্য উপযুক্ত সময় নয়।

নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভোট হবে। এরপর ১২ জুন খুলনা ও বরিশালে এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট হবে।

বাংলাদেশে একসময় ভোট মানেই ছিল উৎসব। সরগরম আলোচনা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাড়িতে কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। মনোনয়ন নিয়ে দলের হাইকমান্ডের কাছে ধরনা। এবার সে রকমটি এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে না। রাজশাহী, সিলেট, গাজীপুর, বরিশাল—পাঁচ শহরে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা হয়। তাঁরা জানান, এখনো কোথাও নির্বাচনী হাওয়া দেখা যাচ্ছে না। যদিও বরিশাল ও গাজীপুরে ক্ষমতাসীন দলের মেয়রপ্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে চাপানউতর চলছে।

একদিকে সিটি নির্বাচন অন্যদিকে আন্দোলন। বিএনপি এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই প্রশ্ন। একদিকে ভোটের হাওয়া আরেক দিকে সেই হাওয়া ঠেকাতে নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি। আন্দোলন দুর্বল হলে ভোটের হাওয়া বেগবান হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি চাইবে আন্দোলন জোরদার করতে। আবার বিএনপির আন্দোলন ঠেকাতে সরকারি দল আওয়ামী লীগও নানা কর্মসূচি দেবে। যেমনটি তারা দিয়ে এসেছে সাম্প্রতিকালে। সে ক্ষেত্রে সিটি নির্বাচন করে আরেক দফা রাজনীতির মাঠে সংঘাতের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আগে বাংলাদেশে সব পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হতো নির্দলীয়ভাবে। দলীয় প্রতীক নিয়ে টানাটানি ছিল না। ২০১৩ সালে পাঁচ সিটিতে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থীরা জিতে যাওয়ার পরই সরকার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সবটা দলীয় নয়। আধাআধি। সিটির মেয়র ও ইউপির চেয়ারম্যানরা দলীয় প্রতীক পাবেন। কাউন্সিলর ও সদস্যরা নির্দলীয়। একই সংস্থার নির্বাচন বা বাছাইয়ে এই দ্বৈত পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। এককেন্দ্রিক বাংলাদেশে স্থানীয় নির্বাচনগুলো যতদিন  নির্দলীয় ছিল, তত দিন ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল। এখন আর সেটি নেই।

আমাদের স্থানীয় সরকার কাঠামোর আরেকটি সমস্যা এর নির্বাচন পদ্ধতি। দেশ চলছে সংসদীয় ব্যবস্থায়। অথচ  স্থানীয় সরকারের নির্বাচনব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির আদলে। এখনো সিটিতে মেয়র কিংবা ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানই সব। অন্যদের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা হয়। অথচ  ভারতে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয় সংসদীয় মডেলে। একটি সিটির প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন। সেই কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে একজন মেয়র হবেন। এতে কাউন্সিলরদের প্রতি মেয়রের দায়বদ্ধতা থাকে। স্বেচ্ছাচারিতা দেখাতে পারেন না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাঁচ সিটিতে গত নির্বাচনে বিএনপির যে পাঁচজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন প্রথম দিকে আগ্রহ দেখালেও এখন নিষ্ক্রিয়। তারা দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী, খুলনার নজরুল ইসলাম (মঞ্জু) ও গাজীপুরের হাসান উদ্দিন সরকার। হাসান সরকার আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে ছেড়ে না দেওয়ার কথা বলেছেন। সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী লন্ডন পর্যন্ত গিয়েছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে। দেশে ফিরে এসেও তিনি নিজের অবস্থান খোলাসা করেননি। বলেছেন, নির্বাচনে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়টি ঈদের পর জানাবেন। আরিফুলের অনুসারীরা চান, দুই মেয়াদে নির্বাচিত মেয়র এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। রাজশাহী ও খুলনার সাবেক মেয়রপ্রার্থীরা কিছু বলছেন না।

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে দেখছেন সরকারের ফাঁদ হিসেবে। তাঁদের বক্তব্য বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতেই নির্বাচনের সময় এগিয়ে আনা হয়েছে। বিএনপি দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নেবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘সিটি নির্বাচন নিয়ে আমরা এখনো আগের সিদ্ধান্তেই আছি। নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই সরকারের অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না।’

এরপরও বিএনপির ভয়,  দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কোনো কোনো নেতা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন  প্রলোভন ও ভয়ভীতির কারণে। সেই অংশগ্রহণ উকিল আবদুস সাত্তারের মতো হলে বিএনপির ক্ষতি নেই। তারা বলতে পারবে, সরকার বিএনপির নেতাদের ভাগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কুমিল্লার মনিরুল হক ওরফে সাক্কু কিংবা নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকারের মতো নেতা নির্বাচনে গেলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাচ্ছে, সেটা বাধাগ্রস্ত হবে।

বিএনপির আরেকটি  সমস্যা হলো, মেয়র পদে তারা নিজ দলের নেতাদের নিবৃত্ত করতে পারলেও কাউন্সিলর পদে সেটি সম্ভব হবে না। সিলেট থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমনকুমার দাশ লিখেছেন, বিএনপির অন্তত এক শ নেতা-কর্মী কাউন্সিলর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার তোড়জোড় চালাচ্ছেন। সিটি নির্বাচনের কোনোটিতে বিএনপি অংশ না নিলে বলা যাবে, এক তরফা ভোট। সরকারের ইচ্ছেপূরণের ভোট। কিন্তু কাউন্সিলর পদে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা দাঁড়িয়ে গেলে একতরফা ভোট বলার সুযোগ থাকবে না। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে যাবে। এ কারণে তারা নেতা-কর্মাদের মন চাঙ্গা রাখতে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নিয়ে আসছেন। দলের  একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ঈদের পর আন্দোলনের কর্মসূচি শহর এলাকায়ই কেন্দ্রীভূত করবে।

একদিকে সিটি নির্বাচন অন্যদিকে আন্দোলন। বিএনপি এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই প্রশ্ন। একদিকে ভোটের হাওয়া আরেক দিকে সেই হাওয়া ঠেকাতে নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি। আন্দোলন দুর্বল হলে ভোটের হাওয়া বেগবান হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি চাইবে আন্দোলন জোরদার করতে।

আবার বিএনপির আন্দোলন ঠেকাতে সরকারি দল আওয়ামী লীগও নানা কর্মসূচি দেবে। যেমনটি তারা দিয়ে এসেছে সাম্প্রতিকালে। সে ক্ষেত্রে সিটি নির্বাচন করে আরেক দফা রাজনীতির মাঠে  সংঘাতের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।  

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি