শিক্ষার ক্ষেত্রেও সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রত্যাশা বিস্তর ও বহুমুখী
শিক্ষার ক্ষেত্রেও সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রত্যাশা বিস্তর ও বহুমুখী

অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা মিশন কী হবে

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এ সরকারের কাছে দেশের মানুষের চাহিদা বহুবিধ ও আকাশচুম্বী। শিক্ষার ক্ষেত্রেও সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রত্যাশা বিস্তর ও বহুমুখী। বড় প্রশ্ন, এসব পরিবর্তনের পরিধি ও সময়সূচি কী হতে পারে?

অতীতের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল সাফ করে সামনে এগোনো কঠিন। তাৎক্ষণিক বহু সমস্যা ও দাবি মাথাচাড়া দিয়েছে এবং আরও দেবে। সচিবালয়ে ছাত্রদের অবরোধ ও দাবির মুখে অসমাপ্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে এবং ভিন্নভাবে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। তাতে আকাশ ভেঙে পড়বে না। কিন্তু চাপে পড়ে নেওয়া কোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত মঙ্গলজনক হবে না।

আধিপত্য ও আনুগত্যের রাজনীতির প্রভাবে ও যোগ্য শিক্ষা-নেতৃত্বের অভাবে গত দেড় দশেক শিক্ষার গতি-প্রকৃতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের যথার্থ আলোচনায় আগ্রহ দেখা যায়নি। সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমুক্ত বর্তমান সরকার নির্মোহ সংলাপে উৎসাহী হবে বলে আশা করা যায়।

 ২০১০ সালে একটি জনসমর্থিত জাতীয় শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছিল। দেশের শিক্ষা উন্নয়নের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল এ নীতিতে। কিন্তু ১৪ বছর ধরে এ নীতি বাস্তবায়নে কোনো সামগ্রিক ও সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যায়নি। এর প্রধান লক্ষ্যের কোনোটাই অর্জিত হয়নি। এসবের মধ্যে ছিল—১. সব ধারার বিদ্যালয়ে সব শিশুর জন্য অভিন্ন মূল শিক্ষাক্রম প্রবর্তন ও একই মানের শিক্ষাসেবার সংস্থান; ২. শিক্ষকের দক্ষতা, মর্যাদা, প্রণোদনা ও কৃতীর মানেও শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় পরিবর্তন; ৩. বিকেন্দ্রায়িত, জবাবদিহিমূলক শিক্ষা শাসন, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা এবং ৪. সময়ের উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরি।

শিক্ষাবিদেরা বলে এসেছেন, সরকারের শিক্ষা উন্নয়ন ছিল খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন, সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে উপসর্গের টোটকা। শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের ২ শতাংশের কম ছিল আওয়ামী শাসনের অধিকাংশ সময়। তবে বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও বিদ্যমান অব্যবস্থা, অদক্ষতা, দুর্নীতি, দুর্বল পরিকল্পনা ও প্রশাসনকাঠামোয় অপচয়-দুর্নীতি আরও বাড়তে পারে বলে শিক্ষা-গবেষকদের ধারণা।

বিগত সরকার শিক্ষায় কৃতিত্বের এক বয়ান দেয়—কন্যাশিশুসহ শিক্ষার্থীসংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকসংখ্যা বেড়েছে, বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়েছে, সব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে, বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু এসব পদক্ষেপ থেকে শিক্ষার অর্জনে যে ফল পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যায়নি মূলত ওপরে উল্লেখিত নানা দুর্বলতার কারণে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল একটি সামগ্রিক শিক্ষা উন্নয়নের রূপরেখা অনুসরণ না করা ও যথেষ্টসংখ্যক পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন নিবেদিত শিক্ষকের অভাব।

বিদ্যালয় শিক্ষাকে দুই মন্ত্রণালয়ের অধীন রেখে সমন্বিত ও সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা ব্যাহত করা হয়েছে। এ রকম বিভক্তি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ২০২২ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে, তা খণ্ডিত উদ্যোগ ও উপসর্গের চিকিৎসার উদাহরণ। এ উদ্যোগ শিক্ষার, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চরম শঙ্কা, উদ্বেগ ও বিভ্রান্তিতে ফেলেছে।

সাম্প্রতিক অভূতপূর্ব ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে কিছু জরুরি ভাবনা ও অগ্রাধিকার সামনে চলে এসেছে।

শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে হবে। এই নতুন ‘স্বাভাবিকের’ পরিবেশ সৃষ্টি করতে স্তরভেদে গাইডলাইন প্রয়োজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সংলাপের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষককে নিয়ে নীতি ও করণীয় নির্ধারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অগ্রণী হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবককে যুক্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সফল গণ-অভ্যুত্থানে চরম ত্যাগও দায়িত্ববোধ দেখিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ভূমিকা রাখার অধিকার অর্জন করেছে। অনতিবিলম্বে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত শিক্ষার্থী সংসদ গঠনে সে সুযোগ তৈরি করতে হবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদগুলোয় পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। প্রশাসকের শূন্যতা দূর করার জন্য শিগগিরই অন্তর্বর্তী নিয়োগ দিয়ে স্থায়ীভাবে উপযুক্ত লোককে পদায়িত করতে হবে। বিদ্যমান আইনের মধ্যে থেকেও কিছু পদক্ষেপ বিবেচিত হতে হবে। পদের যোগ্যতার মাপকাঠি স্পষ্টভাবে বিবৃত করা ও অনুসন্ধানী কমিটি দিয়ে যোগ্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের মধ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ থেমে থাকতে পারে না। নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের অধিকাংশই নতুন সংস্কার প্রবর্তনে একটি বিরতি সমর্থন করেন।

শিক্ষা কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা ও ব্যাঘাত পরিহারের উদ্দেশ্যে দুটি পদক্ষেপ বিবেচিত হতে পারে—১. যেসব শ্রেণির জন্য নতুন পাঠ্যপুস্তক চালু হয়েছে, সেগুলো চালু রাখা যেতে পারে। অন্য শ্রেণিগুলোয় পুরোনো বই ব্যবহৃত হতে পারে; ২. শিক্ষার্থী মূল্যায়নে নানা বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ মোকাবিলার জন্য বর্ষশেষ ও স্তরশেষ পাবলিক পরীক্ষার প্রচলিত লিখিত পরীক্ষা চালু থাকবে এবং শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বর্ষশেষ ও স্তরসমাপ্তির লিখিত পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত না করে আলাদা রাখতে হবে।

বর্তমান ও পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের মধ্যে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের পরামর্শে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি শিক্ষা পরামর্শক কমিটি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এ কমিটি ২০১০ সালের শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী স্থায়ী শিক্ষা কমিশনে রূপান্তরিত হতে পারে।

ওপরে উল্লেখিত ও অন্যান্য স্বল্পকালীন বিষয় ছাড়াও পরামর্শক দল ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসহ জাতীয় অগ্রাধিকার বিষয়ে পরামর্শ দেবে। এসব বিষয়ের মধ্যে থাকবে:

১. বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে শিক্ষার রূপান্তর ও উন্নয়নের পরিকল্পনা;

 ২. শৈশব বিকাশসহ সমগ্র বিদ্যালয়শিক্ষা সমমানেরও একই মূল শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে দেশের সব শিশুর জন্য সময়সীমার মধ্যে নিশ্চিত করা;

৩. শিক্ষকতা ও শিক্ষাকর্ম পেশায় প্রবেশে যথার্থ প্রস্তুতি, দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রণোদনার ব্যবস্থা;

৪. বিকেন্দ্রায়িত বিদ্যালয় ও জীবিকা-সংশ্লিষ্ট শিক্ষার জন্য জেলা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা;

৫. শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক দুষ্ট প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। এই নিবন্ধে এসব বিষয় শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করতে হলো। আমার সম্প্রতি প্রকাশিত একুশ শতকের বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর (প্রথমা প্রকাশন, ২০২৩) বইটিতে এসব বিষয়ের বিশ্লেষণ ও করণীয় উপস্থাপিত হয়েছে।

৬. সব সংস্কারের কাজ অন্তর্বর্তী সরকার সমাপ্ত করবে—এ রকম ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। তবে অগ্রযাত্রার এক সুপরিকল্পিত সূচনা হবে, তা-ই কাম্য।

  •  মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ নেটওয়ার্কের সভাপতি ও গণসাক্ষরতা অভিযানের উপদেষ্টা। নিবন্ধে ব্যক্ত মতামত তাঁর নিজস্ব