ধোপদুরস্ত পোশাকের তরুণ ব্যাংকার। পায়ে প্লাস্টিকের জুতা, পরনে লুঙ্গি, গলায় মাফলার জড়ানো মাঝবয়সী সবজি বিক্রেতা। মধ্যত্রিশের জিনস জ্যাকেট পরা ক্রেতা। সোয়েটার, পাম্প শু আর টুপি পরা ওয়াসার ঠিকাদার। প্রায় গোড়ালিছোঁয়া পাঞ্জাবি পরা তরুণ মাদ্রাসাশিক্ষক।
কারওয়ান বাজারের চরিত্র তাঁরা। বর্ণ, চেহারা, পেশা, বয়সে কোনো মিল নেই। আত্মীয়তার সূত্রেও আবদ্ধ নন কেউ। একমাত্র মিল এই মানুষগুলো হাঁটতে-চলতে থুতু ফেলেন। জনস্বাস্থ্যঝুঁকি, কিংবা ‘বাজে স্বভাব’ হিসেবে স্বীকৃত হোক—থুতু তাঁরা ফেলবেনই। এমনকি কোভিড-১৯–এর মতো এত বড় মহামারিও তাঁদের থুতু ফেলার বাহাদুরি কেউ ঠেকাতে পারেনি। কিন্তু কেন?
বাংলাদেশে যত্রতত্র থুতু ফেলার এই অভ্যাসের সূত্রপাত কবে ও কেন, এর কোনো জুতসই গবেষণা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিবিসিসহ বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম থুতুবিষয়ক প্রতিবেদনের জন্য প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রস কুমবারের সঙ্গে কথা বলেছে। এ নিয়ে তাঁর গবেষণা আছে। থুতু ফেলাটা বৈশ্বিক দক্ষিণের মানুষের নির্দোষ অভ্যাস, না বিরক্তি উদ্রেককারী, ক্ষতিকর, সমাজে অগ্রহণযোগ্য কোনো অভ্যাস তা দেখেছিলেন তিনি। (দেখুন : Public Spitting in Developing Nations of the Global South: Harmless Embedded Practice or Disgusting, Harmful and Deviant)
২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে তিনি এশিয়ায় চীনের সাংহাই, ভারতের মুম্বাইসহ মোট ছয়টি শহর থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন।
তিনি বলেন, ভারত, চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে থুতু ফেলাটা জীবনাচরণের অংশ। তারপরও দেশে দেশে এর রকমফের আছে। যেমন ভারতে লোকে পান খায়। আর পিক ফেলে। চীনে লোকে মনের আনন্দে গলাখাঁকারি দিয়ে থুতু ফেলে। বুকটাকে পরিষ্কার রাখার উপায় বলে মনে করে তারা। তাদের অনেকে বরং পশ্চিমাদের প্রকাশ্যে রুমালের মধ্যে নাক ঝাড়াটাকে ঘেন্না করে।
রস অবশ্য জানাচ্ছেন, একটা সময় পশ্চিমেও থুতু ফেলাটা স্বাভাবিক ছিল। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় তারা এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসে। ২০০৮ সালে টেক্সাসে গ্রেপ্তার এড়াতে একজন এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তি থুতু ছুড়ে দিয়েছিলেন পুলিশের গায়ে। টেক্সাসের বিচারক থুতুকে সে সময় ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
ওই ব্যক্তির কপালে জুটেছিল ৩৫ বছর কারাদণ্ড দেন। যদিও থুতুর মাধ্যমে এইডস ছড়ায়, এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবে রোগের ভয়ে থুতু ফেলার বিরুদ্ধে অভিযান তারা আরও আগে শুরু করেছিল, সেই ১৮৯৬ সালে।
এর বছর কয়েক আগে বিজ্ঞানী রবার্ট কোক যক্ষ্মার সঙ্গে থুতুর সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে যুক্তরাজ্যে প্রায় সব বাসে থুতু ফেলা নিষেধ লেখা হয়। কারণ সেই যক্ষ্মা। তারা প্রকাশ্যে থুতু ফেলে না বহুবছর।
তবুও যুক্তরাজ্যের বেশির ভাগ শহর ২০১১ সালে থুতু ফেলায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। জরিমানার পরিমাণও বাড়ানো হয়।
২০১৬ সালে ভারতের পার্লামেন্টেও থুতুর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কিন্তু আমাদের ‘দেবদাস’ যক্ষ্মায় কাশতে কাশতে মরে গেলেও আমরা থুতু ফেলাকে ভয় পাই না। এমন ভাব যেন, আমাদের থুতুতে কোনো জীবাণু নেই।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) বিশ্বজুড়ে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটা গবেষণা করেছিল। তারা জানায়, ভাইরাসভরা থুতুর ছিটা (ড্রপলেট) স্বল্প দূরত্বে থাকা মানুষকে রোগাক্রান্ত করতে পারে।
ওই সময় তারা ১ হাজার ১২২ জনের ওপর জরিপ চালিয়েছিল। তাদের ৯০৭ জনই যত্রতত্র কাশে-হাঁচে, কফ-থুতু ফেলে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের(সিডিসি) দেওয়া তিনটি পরামর্শ মেনে চলার কথা বলে। তার একটি আমরা কোভিড-১৯–এর সময় স্বাস্থ্য বুলেটিনে প্রতিদিন শুনতাম, ‘হাঁচি–কাশির শিষ্টতা মেনে চলুন’।
ভারতের মুম্বাই আদালত থুতু ফেলা বন্ধে এগিয়ে এসেছেন। কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বেশি জরিমানা আদায় করছে না, জানতে চেয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। চীন বেইজিং অলিম্পিকের আগে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। আমরা চলছি ফ্রি স্টাইলে।
আর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতায় আমরা তো বিশ্ব সেরা। এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্সে বাংলাদেশে ১৮০ দেশের মধ্যে ১৭৭ নম্বরে আছে। এসব নিয়ে হাজারো হল্লাচিল্লা করলেও কেউ আমাদের ঠেকাতে পারেনি। আমরা বীর বাঙালি, রোগের ভয়ে কাবু হওয়ার পাত্র নই! নোংরা–ময়লায় শহর মাখামাখি হয়ে থাকলেও আমাদের পরোয়া নেই। আমরা তো সেই, জাতি যারা (অবশ্যই সবাই নয়) কোভিডের সময় মাস্ক খুলে থুতু ফেলেছি। ভ্রাম্যমান আদালত মাস্ক পরাতে তখন হিমশিম খেয়েছে।
অথচ আমাদের দেশে একাধিক আইনে প্রকাশ্যে থুতু ফেললে জরিমানার বিধান আছে। যেমন বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর ৬০(১) ধারায় বলা আছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত পিকদান থাকতে হবে এবং সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। আরও বলা আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের আঙিনার মধ্যে কেউ বাক্স ও পিকদান ছাড়া ময়লা বা থুতু ফেলতে পারবেন না। ফেললেই শাস্তি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্সে থুতু ফেললে ১০০ টাকা এবং সিলেট ও বরিশালে ৩০০ টাকা জরিমানার বিধান আছে। কোনো আইনকে আমরা ডরাই না। কারণ, আমাদের দেশে আইনের প্রয়োগ নেই।
ভারতের মুম্বাই আদালত থুতু ফেলা বন্ধে এগিয়ে এসেছেন। কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বেশি জরিমানা আদায় করছে না, জানতে চেয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। চীন বেইজিং অলিম্পিকের আগে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। আমরা চলছি ফ্রি স্টাইলে।
গত সপ্তাহে কারওয়ান বাজারের নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করি কেন মানুষ এত থুতু ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, এ সময় কোনো নারীকে থুতু ফেলতে দেখিনি। আমার সহকর্মী মানসুরা হোসাইন অবশ্য বললেন, তিনি একজন নারীকে কায়দা করে থুতু ফেলতে দেখেছেন। আইসিডিডিআরবির গবেষণায়ও অবশ্য প্রকাশ্যে বেশি কফ ফেলা, হাঁচি দেওয়ার পুরুষেরাই ফার্স্ট হয়েছেন।
বিষয়টা কি এমন যে থুতু ফেলা বিরাট পৌরুষের লক্ষণ বা বাহাদুরি? কিংবা কাউকে গণ্য না করা? নাকি নিছক অভ্যেস? এ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা পাঠকদের না জানিয়ে পারলাম না। পান্থপথে বাসার সামনের রাস্তায় একজনকে থুতু ফেলতে দেখে নিষেধ করেছিলাম। জবাব ছিল, ‘রাস্তা কি আপনার বাপের?’ আর পুরান ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র গলায় ঝোলানো এক শিক্ষার্থীকে থুতু ফেলছেন কেন, জানতে চাওয়ায়, আমি পাগল কি না, এমন জবাব শুনতে হয়েছিল।
কারওয়ান বাজারে যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদেরকে পরিচয় দিয়েই প্রশ্ন করেছি, গলাতে ছিল প্রথম আলোর পরিচয়পত্র। ফলে জবাবও ছিল আনুষ্ঠানিক। যেমন তরুণ ব্যাংকার বলেন, ‘সিগারেটে প্রথম টান দেওয়ার পর মুখে একটা তেতো ভাব আসে। তাই থুতু ফেলি।’ একই বক্তব্য ওয়াসার ঠিকাদারের। বাসায় যখন সিগারেটে প্রথম টান দেন, তখন কী করেন? এ প্রশ্নের জবাবে তীব্র বেগে ঘাড় নাড়িয়ে বলেন, ‘বাসার মেঝেতে থুতু ফেলি না।’
বাকিরা বলেন, প্রয়োজনে থুতু ফেলেন। থুতু ফেলতে দেখে একজনের কাছে কারণ জানতে চাই। তিনি চোখ উল্টে ফেললেন, থুতুই নাকি ফেলেননি। গত ১০ দিনে কারওয়ান বাজারে যত মানুষকে থুতু ফেলতে দেখি, তার বহুগুণ পড়ে থাকতে দেখি ফুটপাত ও রাস্তায়।
কিন্তু এই স্বভাবে কি সত্যিই বাহাদুরি আছে? নিজের শহরে যত্রতত্র থুতু ফেলতে গ্লানি হয় না? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিন্তু হতো। দুটি অভিশাপ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম/ কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি/ প্রবল ঢেউ-এর মাথায় ফেনার মধ্যে/ মিশে গিয়েছিল আমার থুতু/ তবু আমার লজ্জা হয়,/ এত দিন পর আমি শুনতে পাই/ সমুদ্রের অভিশাপ।’
এ শহরটা আমাদেরও অভিশাপ দেয়। শোনার মতো কান থাকলে সবাই শুনতে পেত।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই-মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com